কাইয়ুম আহমেদ

  ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পাপিয়া ‘ঝড়ে’ আতঙ্ক

যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া

শুরুটা হয়েছিল গেল বছরের শেষ দিকে। ক্লাব পাড়া দিয়ে। রাজধানীর মতিঝিলের একাধিক ক্লাবে পশ্চিমা ধাঁচে গড়া জুয়ার আসরে ‘ক্যাসিনোবিরোধী’ অভিযান শুরু করে সন্ত্রাস দমনে গড়া চৌকস বাহিনী র‌্যাব। একে একে ধরা পড়েন যুবলীগের কয়েকজন নেতা। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যারা দলীয় পরিচয়ে অপকর্ম করছেন তাদের দলে স্থান না দিতে কঠোর বার্তা দিয়েছিলেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটা মানা হয়নি। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই অভিযানে নামে প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকান্ডে আবার ‘ঝড়’ উঠেছে। খোদ আওয়ামী লীগেই চলছে ব্যাপক আলোচনা।

একাধিক নেতা বলছেন, দলকে আগাছামুক্ত করা না গেলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া দলটির আদর্শ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তখন বিরোধী পক্ষ সুযোগ খুঁজবে। দলে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাই তাদের প্রত্যাশা মুজিববর্ষেই আগাছামুক্ত হবে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি।

এদিকে পাপিয়াকে ১৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ওরফে পিউদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে অনেক পিলে চমকানো তথ্য, অনেকের নাম। তদন্তে উঠে আসছে অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে পিউর বিশেষ সম্পর্ক এবং ব্যবসার বিষয়টিও। এরই মধ্যে র‌্যাব পিউর ঢাকার বাসা, অফিস এবং নরসিংদীর বাড়ি থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করেছে। সেসব তথ্যও এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।

একাধিক সূত্র বলছে, পাপিয়াকে নিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ পাপিয়াকে কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারা বিভিন্ন কমিটিতে বড় পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং কারা পাপিয়ার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন এর সব তথ্য এখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। কীভাবে পাপিয়ার উত্থান হয়েছে সে বিষয়টি নিয়েও তদন্ত চলছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাপিয়া তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। তার অপরাধের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তদন্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, দলে কোনো হাইব্রিড থাকবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুজিববর্ষে আওয়ামী লীগকে আগাছা, পরগাছামুক্ত করা হবে, প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে দল চলবে। কোনো হাইব্রিড, বসন্তের কোকিল নেতা হতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীরাই নেতা হবেন।

ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, মুজিববর্ষে আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমরা আর কোনো অন্ধকারের অপশক্তি দেখতে চাই না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা বাংলাদেশ চালাবে। এটাই হোক আমাদের শপথ।

এদিকে, বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃৃত শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউয়ের অপকীর্তি নিয়ে তোলপাড় চলছে। তার অন্দরমহলে কারা যেতেন, তিনি কাদের কাছ থেকে কী ধরনের সুবিধা পেতেন এ প্রশ্ন হাট-বাজার থেকে ঘর পর্যন্ত। তবে এসব প্রশ্ন মুখরোচক গল্পেই সীমাবদ্ধ নেই, আলোচনা চলছে পাপিয়ার পেছনের রথী-মহারথীদের নিয়ে। ভাইরাল হয়েছে তার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি অনেক ছবি।

পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনের একাধিক মোবাইল ফোনের কললিস্ট, কলরেকর্ড, ভিডিও ক্লিপস ও ছবির সূত্রে শত শত নারী-পুরুষের সম্পৃক্ততার খবর এসেছে। আটকের পর র‌্যাব ও পুলিশ হেফাজতে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও তারা জানিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওয়েস্টিনের রেজিস্ট্রার ও সিসিটিভির ফুটেজে রয়েছে ওই স্যুটে যাতায়াতকারীদের রেকর্ড। সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের হাতে এখন হাইপ্রোফাইল কয়েক ডজন নারী-পুরুষের নাম।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেই এবার আমরা শপথ নিয়েছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত দেশ আমরা গড়বই। এখানে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ সভাপতি।

আওয়ামী লীগের অপর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, তৃণমূল থেকে পাবলিক এ অভিযানের পক্ষে। তারা দুর্নীতির বিপক্ষে, চাঁদাবাজির বিপক্ষে। তাহলে অটোমেটিক এটা আমাদের পক্ষে আসবে। মদ, জুয়া, ক্যাসিনো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স দেখাব।

সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ করলে যা ইচ্ছা তা করা যায় না। আওয়ামী লীগ করতে লাগে নীতি, আদর্শ এবং জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার। নির্বাচনী ইশতেহারে ২১টি অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বর হচ্ছে দুর্নীতি নির্মূল করা। বঙ্গবন্ধু কন্যা নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস করেন না। দেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তিনি এ অঙ্গীকার করেছেন, এখানে কোনো আপস নয়। ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি (শেখ হাসিনা) চলমান অভিযান অব্যাহত রাখবেন।

এদিকে, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম দাবি করছেন, পাপিয়াকে যখন সংগঠনে পদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় তখন তিনিই এর বিরোধিতা করেছিলেন। কারা চাপ দিয়ে তাকে দলে পদ দিল, সেটা তারও প্রশ্ন। ২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

নরসিংদীর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, পাপিয়াকে যুবলীগ নেত্রী বানানোর সময় স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে নেতারা তা আমলে নেননি।

প্রসঙ্গত, গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে ওয়ান্ডারার্সে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র‌্যাব। অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনোর পাশাপাশি সেগুলো পরিচালনায় যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসে। গ্রেফতার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, ঠিকাদার জি এম শামীম, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়া। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল যুবলীগের চেয়ারম্যান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ক্যাসিনো,আওয়ামী লীগ,যুবলীগ,পাপিয়া
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close