কাইয়ুম আহমেদ

  ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯

ঢাকার ২ সিটি নির্বাচন

প্রার্থী ঘোষণায় উদ্দীপনা

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উত্তরের মেয়র পদে আতিকুল ইসলামের ওপরই আস্থা রেখেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে দক্ষিণে বাদ পড়েছেন বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন। এখানে নৌকার বৈঠা তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের হাতে। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে লড়তে দক্ষিণে ইশরাক হোসেন ও উত্তরে তাবিথ আউয়ালকে আগেই বেছে নিয়েছে বিএনপি।

আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আগামীকাল অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর। আর ২ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রত্যাহারের শেষ দিন ঠিক করা হয়েছে ৯ জানুয়ারি। এরপরই শুরু হবে ভোটের লড়াই।

এদিকে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। দলীয় কার্যালয়ে চলছে এখন উৎসবের আমেজ। এ ছাড়া মনোনীত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ঘিরে তাদের কর্মী-সমর্থকরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন।

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনকে ঘিরে বহুদিন বাদে আবার সরব নয়া পল্টন। প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমাÑ এসব নিয়ে ব্যস্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মেয়র পদে দলটির দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল আর ইশরাক হোসেন। তরুণ প্রজন্মের দুই প্রতিনিধিতেই আশার আলো দেখছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা বেগম জিয়ার দল। অন্যদিকে, সব নাটকীয়তা শেষে গতকাল প্রার্থী ঘোষণার পর মিছিল আর সেøাগানে মুখর আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়। উত্তরে আতিকই লড়বেন, তবে দক্ষিণে নতুন প্রার্থী খুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। ক্লিন ইমেজের প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তবে নিজেদের ইমেজ রক্ষায় কমিশনকে নির্বাচনী আমেজ ধরে রাখার তাগিদ তাদের। নেতাকর্মীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে নতুন উদ্দীপনা। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও এখন উৎসবের আমেজ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় তার কর্মী-সমর্থকরা দারুণ খুশি। গতকাল সবুজবাগে বালুর মাঠে গিয়ে দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবর সরদার, কালামসহ ২০-২৫ জন লোক চায়ের দোকানের সামনে জড়ো হয়েছেন। কেউ চা খাচ্ছেন, কেউ ফোনে খুশির খবরটি অন্যদের শেয়ার করছেন। মুজিবর সরদার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের পছন্দের নেতা নমিনেশন পেয়েছেন। তাই সবাই আনন্দিত।’

জনপ্রিয়তার বিবেচনায় প্রার্থী বাছাই : কাদের

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, যারা মনোনয়ন বোর্ডে ছিলেন, তারা প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার বিষয়টি দেখেছেন। গ্রহণযোগ্যতার দিকটি বিবেচনায় নিয়েছেন। সবার সম্মতিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিয়েছেন। এটা নিয়ে বাড়তি কিছু বলার নেই। জনগণের কাছে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দক্ষিণে মেয়র পদে এবারই প্রথম প্রার্থী হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজনকে বেছে নিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারসহ আরো যাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে শেখ ফজলে নূর তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা মা আরজু মণিও ছিলেন। তখন তাপসের বয়স ছিল ৪ বছর।

শেখ ফজলে নূর তাপস ১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে বার এট ল ডিগ্রি লাভ করে বাংলাদেশে আইন পেশায় প্রবেশ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করলে শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার তাপস এবং সবগুলো মামলায় জয় পান। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নামে দুটি সংগঠনে দীর্ঘদিন বিভক্ত থাকায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে এক হয়। আওয়ামী লীগের এই সহযোগী সংগঠনের নাম ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’ এবং শেখ তাপসের সদস্যসচিব। তাপস ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরপর তিনবার ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানেও তিনি এই আসনের সংসদ সদস্য।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে প্রতীক্ষার পালা শেষ না হতেই ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে চলে আসে। ঢাকা উত্তরে বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম আতিকেরই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। কারণ তিনি মাত্র ১০ মাস আগে উপনির্বাচনে মেয়র হয়েছেন। এ ছাড়া এ সিটিতে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি একজন ব্যবসায়ীকে মনোনয়ন দিয়েছে। আতিকুল ইসলামও একজন ব্যবসায়ী নেতা। সব মিলিয়ে আতিকুলকেই বেছে নিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর প্রথম থেকেই পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা প্রবল ছিল দক্ষিণে। এখানে আলোচিত প্রার্থীর সংখ্যা বেশি যারা দলের মনোনয়ন ফরম কিনলেও বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন ছিটকে পড়েছেন। গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন উপকমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঢাকার দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ২০ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ১২ জন, দক্ষিণে আটজন। উত্তরে আতিকুল ইসলাম মনোনয়ন পাচ্ছেন এমনটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। আর দক্ষিণে মূল আলোচনায় ছিলেন বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন এবং ফজলে নূর তাপস। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তাপসকেই বেছে নিল।

অন্যদিকে, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক এবারই প্রথম কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে ঢাকা দুই ভাগ হওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনে উত্তরে মেয়র পদে লড়েছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ। ওই দিন ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যবসায়ী প্রয়াত আনিসুল হক।

বিএনপি পার্লামেন্টারি বোর্ডে মেয়র পদে আগ্রহীদের সাক্ষাৎকার শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল চূড়ান্ত দুই প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন।

এদিকে, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা হয়। পরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, সব বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত জানাতে তাদের একটু সময় লাগছে।

তবে উত্তরে মেয়র আতিকের সঙ্গে দক্ষিণে সংসদ সদস্য তাপস যে চমক হয়ে আসছেন, তা রাতেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় ফেসবুকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিনন্দন বার্তায়। আর গেল বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় সমালোচিত দক্ষিণের মেয়র মো. সাঈদ খোকন যে এবার আর আওয়ামী লীগের টিকিট পাচ্ছেন না, সে আভাস গত ২৬ ডিসেম্বরই পাওয়া গিয়েছিল।

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে খোকন সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, রাজনৈতিক জীবনে আমি এখন ‘কঠিন সময়’ পার করছি।

আর আনিসুল হকের মৃত্যুর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উপনির্বাচনে জিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বে আসেন মো. আতিকুল ইসলাম। তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি আতিক এর আগে ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।

নিয়ম অনুযায়ী, এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে আতিককে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদ থেকে এবং তাপসকে সংসদ সদস্যের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে। সে অনুযায়ী গতকালই স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন তাপস।

আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও ঢাকা উত্তরে তাদের পুরোনো প্রার্থীর হাতে ভোটের টিকিট তুলে দিয়েছে। শনিবার এই সিটিতে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের নাম ঘোষণা করা হয়, যিনি ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আনিসুল হকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। চলতি বছরের শুরুতে এই সিটিতে উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আর দক্ষিণের মেয়র পদে এবার বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন, যিনি এবারই প্রথম কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। ঢাকা দুই ভাগ হওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনে দক্ষিণে মেয়র পদে লড়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস।

গতকাল রোববার সকালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণার আগে সমর্থকদের নিয়ে ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির কার্যালয়ে উপস্থিত হন আতিক ও তাপস। সভাপতিম-লীর কক্ষে গিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বসেন তারা। মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত হওয়ায় বাইরে তখন চলছিল কর্মী-সমর্থকদের তুমুল সেøাগান।

দুই সিটির মেয়র পদের পাশাপাশি ঢাকা উত্তরে ৫৪ এবং দক্ষিণে ৭৫ ওয়ার্ড সাধারণ কাউন্সিলর পদে সমর্থিতদের নামও এ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন ওবায়দুল কাদের। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থিতদের নাম আজ সোমবার ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সিটি নির্বাচন,আওয়ামী লীগ,বিএনপি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close