নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ জুন, ২০১৯

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

রোজ গার্ডেন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই বাড়িতেই জন্ম হয় আওয়ামী লীগের

রোজ গার্ডেন। নামে গার্ডেন বা বাগান হলেও এটি মূলত পুরান ঢাকার টিকাটুলির কে এম দাস লেনের একটি ঐতিহাসিক বাগানবাড়ি। ১৯৩০ সালের দিকে ঋষিকেশ দাস নামের এক ব্যবসায়ী ২২ বিঘা জমির ওপর এই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করেন। ভবনের বাগানে গোলাপের প্রাচুর্য থাকায় বাড়ির নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’। অভিনব নির্মাণশৈলীর কারণে এটি হয়ে ওঠে ঢাকার অন্যতম মনোরম ভবন। স্বেতপাথরে গড়া এই ভবনটি ঋষিকেশ দাস ১৯৩৬ সালের দিকে ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাড়ির নাম রাখা হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’। কিন্তু ‘রোজ গার্ডেন’ নামটি মানুষের মুখে মুখে রয়েই যায়। এই রোজ গার্ডেনকে রঙিন করে সাজানো হয়েছে। কারণ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই বাড়িতেই জন্ম হয় আওয়ামী লীগের।

তখন দলটি আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন টাঙ্গাইলের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন।

অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ; সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রতিষ্ঠার দিন সভায় ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ। পর দিন (২৪ জুন) বিকালে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে জনসভা করে। সভায় আনুমানিক প্রায় চার হাজার লোক উপস্থিত হয়।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু। পরে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা বেরিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। এর প্রায় চার বছর পর ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে দলটির। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাঙালির অধিকার আদায়ের অবিসংবাদিত, অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের বীজমন্ত্রকে ধারণ করে এড়িয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। উজ্জ্বল সংগ্রামের পথ বেয়ে সেই আওয়ামী লীগ আজ ৭১ বছরে পা দিল। এখন দেশের উন্নয়নের সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম থেকেই অবিচল ছিলেন। তার বিশেষ কৃতিত্ব, তিনি এ দাবিতে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং নিজের দলকেও এজন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপনের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই দলটি দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করাটা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সাফল্য। ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৪ বছরের আপসহীন সংগ্রাম-লড়াই এবং ১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। বিশ্বের বুকে বীরের জাতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক চড়াই-উৎরাই এবং ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে আগাতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। কখনো নেতৃত্বের শূন্যতা, আবার কখনো ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে এ দলটিকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিপুল সমর্থনে মহীরুহ হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগকে কোনো বিভেদ ভাঙনই টলাতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এরপর দলের মধ্যে একাধিক ভাঙনও দেখা দেয়।

১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। তিন দশক ধরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেড়েছে এ দলটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে।

বর্তমানে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নতুন দশতলা ভবনটি আওয়ামী লীগের স্থায়ী ঠিকানা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের অফিস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে ৮ থেকে ৯ বার। রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠার পর পালাক্রমে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়িতে বসে দল পরিচালনার নীতি-কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো, কোনো অফিস ছিল না। ১৯৫৩ সাল থেকে ৯ কারকুন বাড়ি লেনে অস্থায়ী একটি অফিস ব্যবহার করা হতো। ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকার ৫৬ সিমসন রোডে দলের অফিস স্থাপন করা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার পর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯১, নবাবপুর রোডে দলের অফিস নেন। এর কয়েক দিন পর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে বসেন নেতারা। পরে পুরানা পল্টনে দুটি স্থানে দীর্ঘদিন দলের অফিস ছিল। ১৯৮১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ঠিকানা হয় আওয়ামী লীগের।

আর প্রতিষ্ঠার ৬৯ বছর পর নিজস্ব ভবন পায় দলটি। দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নতুন দশতলা ভবনটি এখন স্থায়ী ঠিকানা। ৮ কাঠা জায়গার ওপর ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে বিশ্বমানের দলীয় কার্যালয়টি। কার্যালয়টি ওয়াইফাই জোনের আওতায়। সামনে স্টিলের বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। পাশেই দলীয় প্রতীক নৌকা। সবার ওপরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ম্যুরালও।

গেল বছর দলের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন নতুন ভবনে দলীয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন শেষে সামনে একটি বকুল ফুলের চারা রোপণ করেন তিনি।

এদিকে, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে জমকালো, রঙিন, আনন্দ-উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে সারা দেশ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী রাঙাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। ঘোষণা করেছে মাসব্যাপী কর্মসূচি।

নেতারা জানান, রোজ গার্ডেন হয়ে নবাবপুর, নবাবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। গতকাল শনিবারও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আলোকসজ্জা করা হয়েছে।

জানা গেছে, ৭১তম জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগামীকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা করবে। আজ সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সোমবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক হবে।

জানা গেছে, কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলেও পালিত হবে আওয়ামী লীগের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই উপলক্ষে এরই মধ্যে তৃণমূলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ও এর পাশের জেলা নেতাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একাধিক যৌথসভা করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। একইভাবে সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করা হয়েছে। এসব বৈঠকে সাড়ম্বরে, আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আওয়ামী লীগ,প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী,বঙ্গবন্ধু এভিনিউ,রোজ গার্ডেন,বাগানবাড়ি,কর্মসূচি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close