কাইয়ুম আহমেদ ও জিয়াউদ্দিন রাজু
অনুপ্রবেশকারীর রশি টানছে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা বহিরাগতরা। প্রতিদিনই দলে এদের সংখ্যা বাড়ছে। আর এদের বিতর্কিত কর্মকান্ডে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের উন্নয়নে নেতৃত্বদানকারী এই দলের অনেক অর্জনও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। তবে এদের কর্মকাণ্ড আর চলছে না। এসব সুবিধাভোগী অনুপ্রবেশকারীর রশি টেনে ধরতে শুদ্ধি অভিযানে নামছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া নতুন করে বিতর্কিত আর কেউ যেন দলে না ঢুকতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের।
এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পরপরই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। আজ শুক্রবার বিকেলে গণভবনে দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা আসতে পারে বলে জানিয়েছে দলটির দায়িত্বশীল সূত্র। বৈঠকে তৃণমূলে শুদ্ধি অভিযান থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অক্টোবরে দলের জাতীয় সম্মেলন এবং মুজিব বর্ষের কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হবে।
অন্যদিকে, দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠন নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। ২০১৭ সালে সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও সহযোগী তিন সংগঠনের সম্মেলন হয়নি। এই বিষয়েও আজকের বৈঠকে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ বছরে ক্ষমতাসীন এই দলটিতে কয়েক হাজার সুবিধাভোগী ঢুকেছেন। সবচেয়ে বেশি ঢুকেছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। তবে তাদের এই যোগ দেওয়াকে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অভিযোগ রয়েছে, দলের প্রভাবশালী নেতাদের হাত ধরে জামায়াতে ইসলামীর আমির থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের শত শত নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে এসেছেন। এই ক্ষেত্রে বাদ যাননি বিএনপির নেতারাও।
তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের হাত থেকে ফুলের মালা নিয়ে নৌকায় উঠেছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও মাদক মামলা। মূলত মামলা থেকে বাঁচতেই তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলে নেতারা মনে করেন। আর উপজেলা নির্বাচনে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল কারণও এসব অনুপ্রবেশকারী। তাই ত্যাগী ও দীর্ঘ সময় দলকে সেবা দেওয়া নেতাদের বঞ্চিত করে অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় পদ দেওয়ায় অনেক স্থানেই বিপত্তি বেঁধেছে।
এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আসলে বিষয়টি নিয়ে আমরাও খুব বিব্রত। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আজকের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। দলে যাতে আর কোনো সুযোগ সন্ধানী না ঢুকতে পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা আসতে পারে। আর উপজেলা নির্বাচনে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন বা করার চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও আজকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি দলের সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেন। সেদিনই তিনি মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেন। এছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং কৃষক লীগের সম্মেলন করার কথাও তিনি জানান। তবে তারিখ আর ঘোষণা করা হয়নি। এছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের সম্মেলনও কবে হবে তা কেউই জানেন না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলনে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা মূল দলে দায়িত্ব পাবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেজন্য তারা সম্মেলনের অপেক্ষায় আছেন। তারা মূল দলে দায়িত্ব পাওয়ার পর সহযোগী সংগঠনের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। এর আগে পরে এসব সংগঠনের সম্মেলন হতে পারে।
উপজেলা নির্বাচনে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, বিএনপি না এলেও স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন চাঙ্গা রাখতে চায় দলটি। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছেন না নেতারা। তাই উপজেলা নিবার্চনে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই হয়ে উঠছেন নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ এ নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই হয়েছে দলীয় প্রার্থীর। আর অনুপ্রবেশকারীদের কারণে বিভিন্ন উপজেলায় সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।
এ নিয়ে নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি কিন্তু দল আমাকে মনোনয়ন দেয়নি। কারণ এমপি আমার বিপক্ষে। এটা দুঃখজনক।
তবে উপজেলা নির্বাচনে এসব অনিয়ম বা সহিংসতা সতর্ক দৃষ্টিতে রাখছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ— এমনটা জানিয়েছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচনের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, সব প্রার্থীকে সহিংসতামূলক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও কেউ যদি সহিংসতা করে, নির্বাচনের পরে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে দলীয় পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে তৃণমূলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।
পিডিএসও/তাজ