নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

অন্তঃকলহে টালমাটাল জামায়াতে ইসলামী

*গাইবান্ধায় ৪ নেতার পদত্যাগ *দফায় দফায় নেতাদের বৈঠক *কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংস্কার এবং একাত্তর সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা জন্যে ক্ষমা না চাওয়ায় গত শুক্রবার পদত্যাগ করেন দলটির অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরপরই সংস্কার প্রস্তাব যাতে মাথাচাড়া না দেয়, দল থেকে বরখাস্ত করা হয় আরেক কেন্দ্রীয় নেতাকে। আর একাত্তরের ‘ভুল’ শোধরাতে পদত্যাগ করেছেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মো. বখতিয়ার উদ্দিন। এছাড়া দলটির আদর্শকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উল্লেখ করে গতকাল সোমবার গাইবান্ধায় দলটির চার নেতা পদত্যাগ করেছেন।

গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি আবদুল হালিম, সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন, ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সদস্য মো. আলিম উদ্দিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বাদল দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে তারা জড়িত ছিলেন। কিন্তু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতাবিরোধী একটি রাজনৈতিক দল। তারা এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত। এমতাবস্থায় তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সোমবার থেকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করছেন।

এতে আলোচনায় এসেছে দেশটির মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দলটির সংস্কার নিয়ে। এসব বিষয়ে নিয়ে জামায়াতে অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে দলটি। এদিকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। গত রোববার রাতেও ঢাকাসহ দেশের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে একযোগে বৈঠক হয়। সেখানে সংস্কারপন্থিদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে ঐক্য আরও মজবুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি এবং স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে বিচার শুরুর প্রাক্কালে নিজেদের অন্তর্কলহে টালমাটাল অবস্থায় পড়ে দেশের সবচেয়ে ‘বিতর্কিত’ রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত। পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্দার আড়ালে চলছে নানা আয়োজন। কিন্তু দলটির সব ধরনের কর্মকান্ড ‘নিষিদ্ধ’ সংগঠনের ‘তরিকায়’ সম্পন্ন হওয়ায় সেগুলো জনসম্মুখে আসছে না সেভাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, দ্বন্দ্ব বেড়েছে কিনা সেটি বুঝতে আরো সময় লাগবে। তবে ২০০১ সাল থেকে পারস্পারিক ভিন্নমতগুলো সেগুলো এখন অনেক বেশি খোলামেলা হয়ে দাঁড়াল। ২০০১ সালের পর থেকে জামায়াতের ভেতরে সংস্কার এবং ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল তখন সেটি বাইরে বলার মতো লোক ছিল না। আবদুর রাজ্জাক বা মুজিবুর রহমান যা বলছেন, তাতে তাদের প্রশ্ন করা যাচ্ছে। তারা এই সংস্কারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারছেন, যা দলটিতে আগে ছিল না। এখন কর্মী সমর্থকরা একটি ব্যাখ্যা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, এখন বিষয়টি নিয়ে দল ও দলের বাইরে কথা বলার পরিস্থিতি তৈরি হলো।

প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কারের প্রস্তাব জামায়াত গ্রহণ করতে পারে বা তারা হয়তো কিছুই নেবে না। তা না হলে রাজনীতি থেকে সরে আসা—এমন অনেক বিকল্প আছে। তবে আবদুর রাজ্জাক বা অন্যরা যে সংস্কারের কথা বলছে সেটি নেতৃত্বে যারা আছে তারা সেটি গ্রহণ করবে। মিসর ও তিউনিসিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তিউনিসিয়ায় আদর্শিক সংস্কার হয়েছে। আবার রাজনীতি থেকে সরে এসে সামাজিক কাজে জড়িত হয়েছিল মুসলিম ব্রাদারহুড। তারা এখনো করেছে। হেজবুল্লাহ ও হামাস এটি করেছে। জামায়াতের বিষয়ে প্রশ্ন হলো ’৭১ এর বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ই নয়। সংস্কারের বিষয়টা তাদের আদর্শিক অবস্থানের পরিবর্তন।

জামায়াত নেতারা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিলে সেটি কোনো সংস্কার। তাহলে মওদুদীর যে পথ তা থেকে সরে আসতে হবে তাদের। সেটি করবেন কিনা- এসব আলোচনা আগেই হওয়া উচিত ছিল। বহু ইসলামপন্থি দল এটি করেছে কিন্তু জামায়াত সেটি আগে করেনি। রীয়াজ আরো বলেন, শুধু সাংগঠনিক সংস্কারে জামায়াত গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে মনে হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার যেহেতু আমিরে জামায়াত এবং সেক্রেটারি জেনারেলের ওপর ন্যস্ত, সেহেতু এখন থেকে তাদের মাধ্যমেই সব কিছু জানানো হবে। এছাড়া জেলা ও মহানগর আমিরদের মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্ত পৌঁছে দেওয়া হবে তৃণমূল পর্যায়ে।

এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অধিবেশনে নেওয়া সিদ্ধান্ত ‘নির্দেশনা’ আকারে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে পাঠিয়েছে জামায়াত। সেখানে বলা হয়েছে, সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেল এবং জেলা-মহানগর আমিরদের মাধ্যমে জানানো হবে। এর বাইরে কারো আবেদন, নিবেদন ও অনুরোধে কেউ যেন সাড়া না দেন—সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ওই নির্দেশনায় সদ্য দল ত্যাগ করা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে কর্মীদের বিরত থাকতে বলা হয়। পাশাপাশি এটাও জানানো হয়, দলের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে অনুরোধ করা হয়েছিল পদত্যাগ না করার জন্য এবং গণমাধ্যমে পদত্যাগের বিষয়টি না জানানোর জন্য। কিন্তু দলের অনুরোধ তিনি রাখেননি।

কেন্দ্র থেকে পাঠানো চিঠিতে মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দল থেকে বহিষ্কারের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে ভিন্নমত প্রকাশ করে আসছেন মুজিবুর রহমান মঞ্জু। সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকান্ড পরিহার করার জন্য তাকে একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে মুজিবুর রহমান মঞ্জু জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেসব বৈঠকে সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজ দায়িত্বে একটি সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা করেন যা সংগঠনের রীতিনীতি ও শৃঙ্খলাবিরোধী।

এদিকে কেন্দ্রের এ রকম ‘হার্ডলাইন’ অবস্থানের মধ্যেই তৃণমূল জামায়াত থেকে একের পর এক বিদ্রোহের খবর আসছে। গত শনিবার দিনাজপুর খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার উদ্দীন দল থেকে পদত্যাগ করেন। উপজেলা জামায়াতের আমিরের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, ‘এই দেশের নাগরিক হয়ে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে আর থাকতে চাই না।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পূর্ব পুরুষের দায় আর কতকাল বহন করব। আমরা মনে করি, এখনই সময় অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতির মূল ধারায় ফিরে আসার। হাইকমান্ড যদি এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব না দেখায়, তাহলে নিজে থেকেই সরে যাব।’

ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা মনে করি, নানামুখী চাপের কারণে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ কয়েকজন সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। পরিস্থিতি যাতে আরো খারাপের দিকে না যায়, সেজন্য আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জামায়াতে ইসলামী,অন্তঃকলহ,পদত্যাগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close