নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ক্ষমা চাওয়া ইস্যুতে দ্বিধা-বিভক্ত জামায়াত

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীতে। দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে। এই অংশ একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বর্তমান নামে দলকে সচল রাখতে অথবা নতুন নামে দল গঠন করতে চায়। আর অন্য পক্ষ চায় যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দায়িত্বশীলদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ইস্যুতে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ছেন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী দলটির নেতারা।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরগরম আলোচনা। দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে লন্ডন থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করা এবং দলের নাম ও নীতি পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনিচ্ছার কথা উল্লেখ করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের রেশ না কাটতেই জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত হলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। মঞ্জু ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ছাড়াও ছিলেন দিগন্ত টিভির শীর্ষ কর্মকর্তা। মজিবুর রহমান নিজেই গতকাল শনিবার তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বহিষ্কারের বিষয়টি জানিয়েছেন। জামায়াতের একাধিক সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যিনি আইনি লড়াই চালিয়েছেন, সেই আবদুর রাজ্জাক একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে দল ত্যাগের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এটা ইম্পর্টেন্ট বিষয় নয়, যুদ্ধাপরাধীদের একজন আইনজীবী বলেই জানতাম। আমরা স্পষ্ট বলছি, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ওদের ইন্ডিভিজুয়াল কোনো স্টেটমেন্টের গুরুত্ব নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে নিষিদ্ধ হবে। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। রাজ্জাকের পদত্যাগ ও এর কারণ নিয়ে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি এটাকে খুব পজিটিভলি দেখছি। আমি মনে করি, রাজ্জাক সাহেব দেরিতে হলেও তার এ উপলব্ধি ও ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন- খুব ভালো দিক। আমি বিশ্বাস করব, জামায়াতে ইসলামীর সবাই তাই করবেন; দল হিসেবেও তারা তা-ই (ক্ষমা চাইবে) করবেন।

মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি যখন জোটে জামায়াতকে রেখেছিল, আমি স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার হিসেবে সব সময় বলে আসছি—না, তারা স্বাধীনতাবিরোধী দল; তারা মুক্তিযুদ্ধে অনেক মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড করেছেন। দল হিসেবেও জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

রাজ্জাকের পদত্যাগের খবরের প্রতিক্রিয়ায় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমি যতটুকু জানি, যতটুকু পরিচয় আমার রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই উনি একটা মতবাদ বিশ্বাস করতেন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ঠিক ছিল না। উনি আগেও এটা বলেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক আগে থেকে তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন, তা থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাস্তবতাকে উনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন; উনার সিদ্ধান্তের প্রভাব দলেও পড়বে।

আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, এ (রাজ্জাকের) উপলব্ধি নিয়ে মূল্যায়নের কিছু নেই। এসব কৌশলমাত্র। তারা এক জায়গাতেই রয়েছে, আগের জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলার জন্য একটা চক্রান্ত। তারা একটু গুছিয়ে নিয়ে আঘাত করবে। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আগামীতে তারা বড় ধরনের মরণ কামড় দেবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে বলব।

সূত্র জানায়, বেশ কয়েক বছর ধরে সংগঠনের কয়েকটি বিষয়ে মজিবুর রহমান মঞ্জু দ্বিমত করে আসছিলেন। মৌখিক ও লিখিতভাবে বৈঠকগুলোয় তিনি তার দ্বিমত ও পরামর্শের কথা জানানোর পাশাপাশি আকারে ইংগিতে-প্রকাশ্যেও ভিন্নমত প্রকাশ করেন।

জামায়াতের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয়। দলের তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে সভায় একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা মজলিসে শূরায় অনুমোদন পায়নি। সেখানে ২০-দলীয় জোটে আর না থাকা ও কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রায় সবাই একমত হন। তারা একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়ন করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে সম্মত নন। তারা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে এমন মূল্যায়ন করা সঠিক হবে না। প্রবীণদের মধ্যে এই প্রবণতা আগেও ছিল।

দলের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, মূলত দলে এই চিন্তার অনুসারী নেতা ও সমর্থকদের বড় একটি অংশ একাত্তরের মূল্যায়ন করে জামায়াতকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার পক্ষে। তারা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দলকে বিলুপ্ত করার পর নতুন একটি গণতন্ত্র অভিমুখী দল গঠন করে রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব।

এদের মধ্যে তরুণ নেতাদের একজন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। আর তাকেই গত শুক্রবার বহিষ্কার করা হয়। তার সাম্প্রতিক ফেসবুক বার্তা নিয়ে দলের ভেতর নানামুখী আলোচনা হয়। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের প্রায়ই নিজেদের অক্ষমতা, অনৈক্য, নেতৃত্বের সীমাহীন দুর্বলতা নিয়ে আফসোস করতে দেখা যায়। ইসলামিস্টরা এখন দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অকপটে বলছেন, তাদের বয়ান বদলাতে হবে। ইসলামি রাষ্ট্র, খেলাফত বা শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, আগে দরকার সুশাসন, সাম্য, মানবাধিকার। অতএব, নতুন করে আলো জ্বালাবার এই তো সময়।’

দল বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠন করার বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। নতুন দল করার বিষয়টিও আলোচনার টেবিলে আছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি একাত্তরের ভুল স্বীকারের বিষয়ে বলেন, আমরা তো দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান—এগুলো মেনেই কাজ করছি এবং জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তারপরও এ বিষয়ে (মুক্তিযুদ্ধ) আর কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা আছে এবং হচ্ছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ক্ষমা,জামায়াতে ইসলামী,যুদ্ধাপরাধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close