কাইয়ুম আহমেদ

  ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮

নির্বাচনী ইশতেহার : সফল বাস্তবায়নই প্রত্যাশা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ইশতেহার প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ ও ঐক্যফ্রন্ট। গত মঙ্গলবার সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইশতেহার প্রকাশ করেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই ইশতেহারে উন্নয়ন সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার দৃঢ়প্রত্যয় করেন শেখ হাসিনা। আবারও ক্ষমতায় যেতে পারলে ২১ দফা অঙ্গীকার তুলে ধরে সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। একই দিন গুলশানের হোটেল লেকশোরে বিএনপি তাদের ইশতেহারে ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইশতেহার ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষ সংসদ প্রতিষ্ঠা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট বাতিল বিশেষ ক্ষমতা আইন ৭৪ বাতিল, বেকার ভাতা প্রদানসহ ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

দুই দলের এই ইশতেহার নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। কেউ বলছেন, ইশতেহার আসলে এখন কথার কথা হয়ে গেছে। কেউ বলছেন, ইশতেহার কতটুকু কার্যকর হবে সেটাই দেখার বিষয়। তবে এই ইশতেহারের সফল বাস্তবায়ন হবে এমন প্রত্যাশা সবার।

ইশতেহার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইশতেহার ঘোষণা করে তাতে জনগণের খানিকটা আগ্রহ থাকতে পারে কিন্তু আস্থা আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমরা অতীতের ইশতেহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব প্রতিটি দল সর্বোচ্চ ভালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তবে ক্ষমতায় এলে সব ভুলে যায়।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ইশতেহার এখন ঘোষণাতেই আটকে থাকছে। ইশতেহার এখন কথার কথা। এছাড়া উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছেও। কিন্তু সেই উন্নয়ন সমাজে আরো বৈষম্য বাড়াচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো দৈন্যদশায় পড়েছে। সমস্যা চিহ্নিত হবে কীভাবে, সমাধান কীভাবে তার কোনো ইঙ্গিত নেই ইশতেহারগুলোয়।

অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে ‘তরুণদের সঙ্গে প্রহসন’ বলেছে আওয়ামী লীগ। গতকাল বুধবার দুপুরে ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দেশবাসী বিএনপির অবান্তর ও কল্পনাপ্রসূত ইশতেহার প্রত্যাখ্যান করেছে।

আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকন্যা আগামীর স্বপ্ন বুনেছেন। সম্ভাবনার কথা বলেছেন। মানুষের পেটে ভাত দেওয়া,

মা-বোনদের কাপড় নিশ্চিত করা, তরুণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি আগামী দিনের বাংলাদেশের এক আশাজাগানিয়া প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুকন্যা এবারের ইশতেহার উপস্থাপনের সময় স্বদেশের আশার ক্ষেত্রকে বড় করা এবং আমাদের শক্তির দ্রুত উল্লম্ফন দেশি ও বিদেশি দর্শকদের সামনে খবিই মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

এবারের ইশতেহারের নতুন দিকটি হচ্ছে, বদ্বীপ পরিকল্পনার অধীনে সমন্বিতভাবে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি এসডিজি (২০৩০) এবং উন্নত বাংলাদেশ (২০৪১) গড়ার অঙ্গীকারগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সংবিধানকে সর্বোচ্চ দলিল হিসেবে দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার রয়েছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে।

ড. আতিউর আরো বলেন, ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ নিঃসন্দেহে অভিনব সংযোজন। যুব শক্তিকে সংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও উৎপাদনমুখী করা গেলে দেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই উন্নত হবে না; সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদকমুক্ত হবে।

ধানের শীষ প্রতীকের মূল জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শরিক দলগুলোর পক্ষে ইশতেহার ঘোষণার পর দিনই বিএনপি আলাদা করে ইশতেহার ঘোষণা করেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে ইশতেহারও জোটবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। ঐক্যবদ্ধ জোট যদি একবার ইশতেহার দেয় সেখানে ওই জোটের কোনো দলের আলাদা ইশতেহার দেওয়ার দরকার নেই। দিয়ে থাকলে সেটা অবশ্যই মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়।

প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট তো একীভূত ইশতেহার দিয়েছে। সেখানে আবার বিএনপির আলাদা ইশতেহার দেওয়ার গুরুত্ব থাকে না। যতটুকু জানি ড. কামালসহ অনেকে জামায়াতকে সঙ্গে নিতে চায়নি। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের কাঠামো ধরে বিএনপি-জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না। এই প্রশ্নেই হয়তো দলটির আলাদা ইশতেহার দেওয়ার মতো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।’

প্রবীণ এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘এবার ইশতেহারের যে প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি তাতে সাধারণ ভোটাররা অনেক বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। আর ইশতেহারে যেভাবে কথার ফুলঝুরি ছড়ানো হচ্ছে, বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর হবে সেটাই দেখার বিষয়। ইশতেহার ঘোষণা করে যদি তা পূরণ করা না হয় সেটা হবে ভোটারদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যখন ইশতেহার ঘোষণা করেছে, ধরেই নিতে হবে এটা তাদের জোটের একীভূত ইশতেহার। সেখানে আলাদা করে বিএনপির আরেকটি ইশতেহার দেওয়ার মানে ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করা। তাছাড়া ঐক্যফ্রন্টের ভেতরকার বিশৃঙ্খলার বিষয়টিও ফুটে উঠেছে আলাদা ইশতেহার দেওয়ার মাধ্যমে। সেই সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের মোড়কে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না সেটা প্রমাণ হয়ে গেল।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারসহ ১৪টি প্রতিশ্রতি ও ৩৫টি অঙ্গীকার রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তহীনতা এবং যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে বিষয়টি মীমাংসিত হয়নি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রত্যাশা,নির্বাচনী ইশতেহার,নির্বাচন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close