প্রতীক ইজাজ

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

নির্বাচনী উৎসবে দেশ

ব্যস্ত রাজনৈতিক দল, দৌড়ঝাঁপ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের

দেশে নির্বাচনী উৎসব বইছে। রাজনৈতিক দল ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পাশাপাশি এ উৎসবের দোলা সাধারণ মানুষের মধ্যেও। সর্বত্র এখন একই আলোচনা। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। এ উৎসবের দোলা রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত।

গত বৃহস্পতিবার প্রথম দফা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনকে ঘিরে উৎসব দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তফসিলকে স্বাগত জানায়। পরে গত রোববার সব সংশয় দূর করে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলে উৎসব নতুন মেরূকরণ পায়। বিশেষ করে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ কিছু রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন এক সপ্তাহ পিছিয়ে গত সোমবার পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচনকে ঘিরে নতুন আস্থা আসে মানুষের মনে। গতি পায় নির্বাচনী উৎসবে।

নতুন তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৮ নভেম্বর, বাছাই ২ ডিসেম্বর এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৯ ডিসেম্বর। এর আগে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

এরই মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিসহ সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত রোববার ১৪ দলের এক বৈঠকে তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই সরকারের লক্ষ্য। জনগণ যাদের ভোট দেবে তারাই বিজয়ী হবে।

নির্বাচন কমিশন ভোটের মাঠে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, যে যেই অবস্থানে থাকুক না কেন, প্রার্থীকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে হবে। সব প্রার্থীকে সমান সুযোগ দিতে হবে। আইনগতভাবে কেউ যেন বঞ্চিত না হন, আবার কেউ যেন বাড়তি সুবিধা না পান। তবে নির্বাচন আর পেছানোর কোনো উপায় নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ হবে। এই তারিখকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে। এমনকি নির্বাচনী পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে দলীয় কার্যালয় বা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা নিয়ে যেকোনো মিছিল-শোডাউন বন্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবারই একটি চিঠি পুলিশের মহাপরিদর্শককে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলীয় কার্যালয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়নপত্র গ্রহণ বা জমা দেওয়ার সময় মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন সহকারে মিছিল ও শোডাউন করা হচ্ছে। যা সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী আচরণ বিধিমালা-২০০৮ এর ৮ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সারা দেশে নির্বাচনী উৎসব চলছে। সব দল নির্বাচনে এসেছে। আশা করছি তারা শেষ পর্যন্ত থাকবে। এবার নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। সরকারও চায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। সুতরাং নির্বাচনী বিধি মেনে সবাই নির্বাচনে থাকলে এ উৎসব অব্যাহত থাকবে।

তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে নির্বাচনে টিকে থাকাটা ইসি ও সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে। নির্বাচনী উৎসবের যে গন্ধ তারা পাচ্ছে, সেটা থাকবে কি না তাও নির্ভর করছে সরকারের ওপর।

নির্বাচনকে ঘিরে ব্যস্ত এখন রাজনৈতিক দলগুলো। সরগরম দলীয় কার্যালয়। কেন্দ্র থেকে শুরু তৃণমূলেও উৎসব। কেন্দ্র থেকে নানা ধরনের নির্দেশনা যাচ্ছে তৃণমূলে। সে অনুযায়ী সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন ফরম বিক্রি, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার, দলীয় এবং শরিক ও মিত্রদলগুলোর মনোনয়ন চূড়ান্ত এবং আসন ভাগাভাগিসহ নানা নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাকর্মীরা। শরিকদের সঙ্গে আসন ও প্রার্থী নিয়ে দরকষাকষিতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে দলের নীতিনির্ধারকদের। সেই সঙ্গে সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে রাজনৈতিক ও ভোটের মাঠের প্রতিপক্ষের নির্বাচনী কৌশলের দিকেও। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে- সে বিচার-বিশ্লেষণেও সময় দিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।

গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের ফরম বিতরণ শুরু করার পর থেকে ধানমন্ডি এলাকা সরগরম। মনোনয়ন ফরম বিক্রিকে শুরু করে দীর্ঘ বছর আবারো সরগরম হয়ে উঠেছে বিএনপির নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ নানা স্তরের নেতাকর্মীরা ভিড় করেই আছেন কার্যালয়গুলোতে। সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও মহাজোট নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এরই মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ হয়েছে। প্রতিটি আসনে গড়ে ১৩টির বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে দলটি। গতকাল মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা নির্ভর করছে জোট ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন নিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। তবে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী নির্বাচন কৌশলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে দলের ধানমন্ডি সভাপতি কার্যালয় ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় লেগেই আছে নেতাকর্মীদের।

একইভাবে দলীয় ১০০ প্রার্থী চূড়ান্ত করে রেখেছে বিএনপি। চলছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি। কিন্তু দলীয় প্রার্থীর ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকদের প্রার্থী নির্বাচন কৌশলের ওপর। কেননা সেটার ওপর নির্ভর করেই ভোটের মাঠে নামতে চায় দলটি। তবে দলটি তাকিয়ে আছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দিকে। আসন ও প্রার্থী ভাগাভাগিতে অনেকটাই ছাড় দিতে হতে পারে এই দলকে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ও প্রার্থী নিয়ে সমঝোতার অপেক্ষায় জাতীয় পার্টি। মনোনয়ন ফরম বিক্রি চলছে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। সেখানে ভিড় লেগেই রয়েছে নেতাকর্মীদের। জাতীয় পার্টি মহাজোট হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেও তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এখনো আসন নিয়ে সমঝোতা হয়নি। ফলে দলটি দলীয় প্রার্থীও চূড়ান্ত করতে পারছে না। গত রোববার দলের পক্ষ থেকে ১০০ আসনের একটি তালিকা আওয়ামী লীগকে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েই জাতীয় পার্টি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দলের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। অবশ্য এর আগে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, আমরা আওয়ামী লীগের কাছে ১০০ আসনের তালিকা দিয়েছি। এর মধ্যে ৭০ আসন তো পেতে পারি। তবে এ বিশাল তালিকা পূরণ করতে আওয়ামী লীগ প্রস্তুত নয় বলে দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন।

নির্বাচন বিশ্লেষদের মতে, নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে এখনো সময় আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরূকরণ সম্পন্ন হবে। কোন দল কোন জোটের হয়ে নির্বাচন করবে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে কয়েক দিনের মধ্যেই। এ সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় দলগুলো শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। মত-পথের পার্থক্য সত্ত্বেও এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথেষ্ট অংশগ্রহণমূলক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত হলেই মূল ভোট উৎসব শুরু হবে।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন পুরোটাই ভোটকেন্দ্রিক। সর্বত্র এখন একটিই আলোচনা। অলিগলি, পাড়া-মহল্লার চা দোকানে, মফস্বলের হাটবাজারে এখন শুধুই নির্বাচনী আলোচনা। কয়েক দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে দলভিত্তিক কোথায় কে পেতে যাচ্ছেন কোন দলের মনোনয়ন। দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পাশাপাশি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা শুরু করে দিয়েছেন রাজনৈতিক তদবির। বিশেষ করে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন এমন নেতাদের বাসায়-অফিসে ধরনা দিচ্ছেন তৃণমূলের অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩২৯ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৫১ জন। ভোটকেন্দ্র ৪১ হাজার ১৯৯টি। ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬ হাজার ৫৪০টি আর এই মহাকর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিয়োজিত থাকবেন ৭ লাখেরও বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা।

অন্য বছরের মতো এবারও সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিতে সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান) মোতায়েন থাকবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে সেনাবাহিনী। গত বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাকালে বলেন, নির্বাচনে লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড যেভাবে হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে- সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংসদ নির্বাচন,মনোনয়ন,রাজনৈতিক দল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close