প্রতীক ইজাজ

  ০৯ অক্টোবর, ২০১৮

জাতীয় নির্বাচন কবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কবে ভোটগ্রহণ ও নির্বাচনের তফসিল কবে তা এখনো যেমন জানা যাচ্ছে না; তেমনি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা দিতে পারছেন না কেউ। এবার আদৌ কি এ ধরনের কোনো সরকার হবে, নাকি সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই ছোট আকারে নির্বাচনকালীন সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করবে, তাও স্পষ্ট নয়। বরং নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব সাংবিধানিক বিষয়ে একেক সময় একেক ধরনের কথা ওঠায় এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে রাজনীতিতে।

সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিএনপি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবিগুলো সংবিধানবিরোধী এবং সংবিধান সংশোধনীর পর্যায়ের। এই মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো ইচ্ছা নেই সরকারের। তাই তাদের দাবিগুলো একাদশ নির্বাচনের আগে মানা ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সংবিধানের বিধান মেনেই একাদশ নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই করতে হবে। তার নির্বাচনী সরকারের অধীনেই বিরোধী জোটকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। আপাতত সংবিধানের বাইরে এক চুলও সরার চিন্তা নেই তাদের।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকার সংবিধানের বাইরে যাবে না। যেসব দাবি-দাওয়া আসছে সেগুলো সংবিধান পরিপন্থী এবং অগ্রহণযোগ্য। সংবিধান এগুলো গ্রহণ করবে না। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তারিখে নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কবে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময় কেমন সরকার হবে তা সময় হলেই সবাই জানতে পারবে। তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নিশ্চয় তারা তাদের বিধির মধ্যে থেকেই তফসিল ঘোষণা করবে। সুতরাং এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুযোগ নেই।

গত কয়েক দিন ধরে দেশে নির্বাচনের তিনটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এগুলো হলো নির্বাচনের তারিখ, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ও গঠনের দিনক্ষণ এবং তফসিল ঘোষণা। এর আগে বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এক ধরনের ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারে বক্তব্যকে ঘিরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত শনিবার বিকেলে সুনামগঞ্জে উন্নয়ন মেলায় ইভিএম প্রদর্শন কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে’ এমন কোনো কথা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। নির্বাচনের তফসিল কবে ঘোষণা হবে—এটা এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে—এটা আমরা বলিনি। যারা বলেছেন, সেটা তাদের কথা। উনারা উনাদের হিসাব মতো বলেছেন।

অথচ এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বগুড়া জেলা প্রশাসন আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সর্বশেষ সিইসি বলেছিলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। তবে ভোটগ্রহণের সময় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আশা করি নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারও আগে ২৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তিন দিন আগেও ঢাকায় গণসংযোগে গিয়ে ডিসেম্বরেই নির্বাচনের কথা বলেন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সিইসির বক্তব্যের পরপরই গত রোববার নতুন করে জানুয়ারির কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখের আগে যেকোনো দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারে। সেটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার।

এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারেও গত রোববার নতুন করে কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। ভোটের সময় সরকারের আকার ছোট হওয়ার কথা জানিয়ে এত দিন নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলে আসছিলেন তিনি। কিন্তু গত রোববার বলেন, কোনো অন্তর্বর্তীকালীন, নির্বাচনকালীন সরকার হবে না। সরকার যেটা আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সরকারই থাকবে। তবে সরকার তখন রুটিন ওয়ার্ক করবে। সরকারের দায়িত্বের এরিয়া বদলে যাবে। মেজর দায়িত্ব থেকে সাধারণ দায়িত্ব, রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। হয়ত সাইজটা একটু ছোট হবে। সেটা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে হতে পারে।

ফলে নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনী তফফিল নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে দেশে। কবে ভোটগ্রহণ ও তফসিল ঘোষণা এবং কবে নাগাদ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হতে পারে ও এর রূপরেখা কি হতে পারে, এ নিয়ে নানা আগ্রহ নানা মহলে। গতকাল সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব ব্যাপারে এক ধরনের ধারণা পাওয়া গেছে।

কবে তফসিল ও ভোট : সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ তফসিল ঘোষণার পরে করা হবে। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার সময় এখনো আসেনি। তফসিল ঘোষণা করা হবে মূলত নির্বাচনী সময় গণনা শুরুর পরে ৩০ অক্টোবরের পর। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।

ইসি সূত্র মতে, ভোটের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে চলতি অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে ইসি। এরপর ভোটের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিলের সিদ্ধান্ত নেবে। ডিসেম্বরে না হলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা দেন কমিশন কর্মকর্তারা। সাধারণত তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত ৪৪-৪৭ দিন হাতে রেখে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে ইসি।

ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে ৬০ দিন, দ্বিতীয় ৫৪ দিন, তৃতীয় ৪৭ দিন, চতুর্থ ৬৯ দিন, পঞ্চম ৭৮ দিন, ষষ্ঠ ৪৭ দিন, সপ্তম ৪৭ দিন, অষ্টম ৪২ দিন, নবম ৪৭ দিন ও দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ দিন সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করেছিল কমিশন।

নির্বাচনকালীন সরকার কবে : যদিও ওবায়দুল কাদের বলছেন, নির্বাচন বা অন্তর্বর্তীকালীন কোনো সরকার হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারই নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকবে। সরকারের আকার আকারে ছোট হতে পারে। কিন্তু আইনজ্ঞ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটাকেই নির্বাচনকালীন সরকার বলছেন।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্র মতে, প্রথমে অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথম দিকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের চিন্তা ছিল। কিন্তু সেটা কিছুটা পেছাতে পারে। তবে কবে নাগাদ গঠন হতে পারে তা বলতে পারছেন না কেউ। এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতারা বলেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনিই এ ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নেবেন।

আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে মন্ত্রিপরিষদ ছোট আকারে করতে পারেন। নির্বাচনকালীন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার বলে সংবিধানে কোনো সরকার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ নেই।

সংবিধানের ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদেও মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করিতে হইবে।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সে হিসাবে সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। এর ৯০ দিন আগে অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো দিন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে গত রোববারও কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গণভবনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চিকিৎসক সম্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার রুটিন কাজ ছাড়া বড় সিদ্ধান্ত নেবে না। একটা সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু ওই পাঁচ বছরের সময় শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন সরকার শুধু রুটিন কাজগুলো করতে পারে। এখন আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। তবে এর আকার নির্ধারণ করার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনিই এটি নির্ধারণ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী ৩০ জনের মতো সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করতে পারেন। এই মন্ত্রিসভায় কারা আসবেন, কারা বাদ পড়বেন, শরিকদের মধ্য থেকে কাউকে নেওয়া হবে কিনা—তা প্রধানমন্ত্রী জানেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় নির্বাচন,সংসদ নির্বাচন,তফসিল,নির্বাচনকালীন সরকার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close