প্রতীক ইজাজ

  ০৮ অক্টোবর, ২০১৮

জাতীয় ঐক্যে তীক্ষ্ণ নজর আ.লীগের

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট। ভালো চোখে দেখছে না এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা। আবার বিএনপি চাচ্ছে যেকোনো শর্তে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে। সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে। এজন্য বিশেষ কৌশলে এগোচ্ছে দুই দলই।

যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ওপর সতর্ক নজর রাখছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের মতে, ভোটের রাজনীতিতে এই জোট তাদের জন্য কোনোরকম সংকট বয়ে আনবে না। রাজনীতিতে এই জোট নেতাদের তেমন কোনো প্রভাব নেই। এমনকি জোট নেতাদের কারো কারো বিরুদ্ধে অতীতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আছে। তবে ক্ষমতাসীনদের চিন্তা ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে নিয়ে।

তারা মনে করেন, বিএনপি এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে নামলে নির্বাচনের জন্য কিছুটা হলেও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ এর মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য বিষয়ে এক ধরনের বার্তা যাবে সবার কাছে। পাশাপাশি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র আরো প্রকট হতে পারে। এমনকি যেসব নির্বাচনী ইস্যুতে আন্দোলন করছে বিএনপি, সেখানে কিছুটা হলেও সুবিধা পেতে পারে বিরোধীরা।

সেক্ষেত্রে শুরুতে এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানালেও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন এবং সরকারবিরোধীদের নিয়ে মাঠে নামাকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট। বিশেষ করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নানা তৎপরতা ও ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং ওই সমাবেশে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিকে ভালো চোখে দেখছেন না ক্ষমতাসীনরা।

তবে এই মুহূর্তে কঠোর অবস্থানে না গিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখার পক্ষপাতী সরকার ও ক্ষমতাসীন জোটের নীতিনির্ধারকরা। দলীয় ও জোটের সভা-সমাবেশ এবং কর্মসূচিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও এর নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে তাদের চাপে রাখতে চান তারা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কিছুতেই চাইছে না বিএনপি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হোক এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিক।

পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও জোটের নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রেখে সম্ভাব্য ‘নাশকতা’ সৃষ্টির চেষ্টা রুখে দাঁড়ানোর কৌশল নির্ধারণেও ব্যস্ত রয়েছেন ক্ষমতাসীন এ জোটের শীর্ষ নেতারা।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও জাতীয় ঐক্য ও তাদের নাগরিক সমাবেশের সমালোচনা ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার তৎপরতাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলেসহ এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় জড়িত কয়েক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে তিনি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে গিয়ে সেখানে স্থানীয় হিলটন হোটেলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, খুনি, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী এবং সুদখোররা সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। এরা ক্ষমতায় এলে দেশকে ধ্বংস করে ফেলবে। তবে জনগণ তাদের সমর্থন করে না।

অবশ্য জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া বা তাতে বিএনপির যুক্ত হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা শুরুতেই এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে বিএনপির নেতাদের উপস্থিতি ও তাদের দাবি পর্যালোচনায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। সুতরাং, আমরা আশা করব এই ঐক্য নির্বাচনে অংশ নেবে। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতা করবে। নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র যেন না করে।

এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এই নেতা বলেন, সমাবেশে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপি তো ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েই ফেলেছে। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আশা করছি বিএনপি নির্বাচনে আসবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, এ অবস্থায় বিশেষ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে দলটি। বিএনপির ঐক্যে একীভূত হওয়া-না হওয়ার ওপর নির্ভর করছে দলের নির্বাচনী কৌশল। একীভূত হলে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে ১৪ দল সম্প্রসারণের চিন্তাও রয়েছে দলে। আসন বণ্টন নিয়েও ভাববে তখন। এমনকি ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেও কোনো কোনো নেতাকে নিজেদের দিকে টানা হতে পারে বলেও আভাস রয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারেও কেউ কেউ সুযোগ পেতে পারেন বলেও আলোচনা শোনা যাচ্ছে।

এসব সমালোচনার মূল লক্ষ্য জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভাজন তৈরি ও তাদের বিপক্ষে জনমত গঠন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার জোটের নেতাদের ‘দলছুট ও জনবিছিন্ন’ উল্লেখ করে তাদের নেতৃত্বে নেতাদের এই জোট খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেও মনে করেন দলের নেতারা। আর জাতীয় ঐক্যের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির যুক্ত হওয়ার পর এটাকে জগাখিচুড়ি ঐক্য বলে আখ্যায়িত করেছেন তারা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মতে, নির্বাচনকে ঘিরে ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের’ পথ ধরে সুবিধা নিতেই তাদের এই তৎপরতা। তবে শেষ পর্যন্ত এই জাতীয় ঐক্য টিকবে না বলেও ধারণা তাদের।

বিশেষ করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে বিএনপির উপস্থিতি ও দলটির নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির পরে জাতীয় ঐক্যের কর্মকাণ্ডকে আরো বেশি তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছে আওয়ামী লীগ। আবার একইসঙ্গে এই ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আসলে এটা জগাখিচুড়ি ঐক্য। এই জগাখিচুড়ি ঐক্য শেষ পর্যন্ত টিকবে; এটা আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনো ধরনের সহিংসতা বা নাশকতা মেনে নেবে না সরকার বলে জানান ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। শুরু থেকেই সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে এই প্রক্রিয়া কোনো ধরনের উসকানি বা সহিংসতা সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন বানচালের যেকোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। এমনকি এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি আছে বলেও জানিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে মনে করছেন, বিএনপি বুঝে গেছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারসহ তাদের অন্য দাবিগুলো বাস্তবায়ন হবে না। এর মধ্যে ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের দিন ধার্য আছে। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হতে পারে। এই অবস্থায় বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা আরো নাজুক হবে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হবে দলকে। অথচ এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই দলের সামনে। এ জন্য তারা মরিয়া হয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চাইছে।

এ ব্যাপারে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করলে দলের ভেতরেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে। তারা সেই পথে হাঁটবে না বলে মনে হয়। আর বিএনপি জোট ২০১৪ সালে নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। আগামী নির্বাচনেও পারবে না। সরকার, আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের সেই প্রস্তুতি আছে। তিনি জানান, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল সভা-সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখবে। তফসিল ঘোষণার পর প্রচার কৌশলে পরিবর্তন আসবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় ঐক্য,আ.লীগ,একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন,১৪ দল,নির্বাচনী ইস্যু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close