কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ০৫ অক্টোবর, ২০১৮

আ.লীগের কোন্দলে তরীকতের সুবিধা, বিএনপিতে নতুন মুখ

নব্বই পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন আওয়ামী লীগের টানা জয় থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তা ভেস্তে যায়। এই সুযোগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের অংশ হিসেবে জয়ী হয়েছে তরীকত ফেডারেশনের প্রার্থী। আসন্ন নির্বাচনে এই আসন ঘিরে তাই বহুমুখী হিসাব কষছে সংগঠনগুলো।

চট্টগ্রাম-২ আসন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এখান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। কিন্তু এখন উপজেলা আওয়ামী লীগে কয়েকটি বিবদমান পক্ষ রয়েছে। ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত। এর একটির নেতৃত্বে আছেন ২০০৮ সালের মহাজোটের পরাজিত প্রার্থী ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম।

অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার ও তার চাচা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের অংশ হয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। বর্তমানে ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ তীব্র কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ফের মহাজোটের প্রার্থী হতে পারেন।

প্রায় আট বছর ধরে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছেন এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। এ কারণে স্থানীয় মধ্যমসারি নেতাকর্মীদের মধ্যে তার ভালো অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে, খাদিজাতুল আনোয়ার ও তার চাচার সঙ্গে উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ ভালো। তবে একই পরিবারের হলেও চাচা-ভাতিজির মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আছে। খদিজাতুল ২০১৪ সালে দলের মনোনয়ন পেলেও পরে দলের নির্দেশনা অনুযায়ী তরীকতের প্রার্থীর সমর্থনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন।

দলে বিরোধ ও মতপার্থক্য থাকলেও এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম ও রফিকুল আনোয়ারের পরিবার তরীকতের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর পক্ষে গত নির্বাচনে প্রচারণা চালান। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী নুরুল আলম চৌধুরী, এম তৌহিদুল আলম বাবু, এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এবং ফখরুল আনোয়ার।

আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ফটিকছড়িতে জয় পায় বিএনপি। এ বছর দল থেকে প্রার্থী হতে চান দুইয়ের অধিক প্রার্থীর। এর মধ্যে এগিয়ে আছেন সাংবাদিক কাদের গণি চৌধুরী ও ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী। তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ইমেজ কাজে লাগাতে বিএনপির নতুন প্রার্থী হিসেবে এখানে দেখা যেতে পারে তার স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী কিংবা ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীও।

গত নির্বানে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হলেও নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর জোট বদলের ইতিহাস মন্দ নয়। ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নেন আওয়ামী লীগ থেকে, ৬ষ্ঠ সংসদে বিএনপি থেকে এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে নির্বাচিত হন।

প্রতিদিনের সংবাদকে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন না দিলে কাকে দিবে? আমিও বা যাব কোথায়? আমার দায়ের করা ধর্ম অবমাননা মামলায় জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যন্ত গড়িয়ে ফাঁসি কার্যকর হয়। জামায়াতের ফেসবুক পেজ বাঁশেরকেল্লায় আমার ছবি দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া আছে। আমাকে হত্যা করার জন্য ব্রাশফায়ার করা হয়েছে। সব মিলে আমি মাঠে থাকতে হবে। নির্বাচন করতে হবে। ফটিকছড়িবাসীর সুখে-দুঃখে বিগত দিনের মতো আমি আছি।’

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগ করে কলেজ সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছিলাম উপজেলা চেয়ারম্যান। দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ফটিকছড়িতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। মাঠের নেতাদের দল মূল্যায়ন করলে মনোনয়ন আমি পাব। নেত্রীর ওপর আমাদের আস্থা অবিচল।

৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদে ফটিকছড়ি আসনের এমপি প্রয়াত রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি বলেন, ‘আমার বাবা আর স্বামীর যে পরিমাণ সম্পদ আছে তাতে আমার পরবর্তী প্রজন্ম আরামে চলে যাবে। কিন্তু জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকান্ডের ধারা অব্যাহত রেখে ফটিকছড়িবাসীর পাশে থাকতে আমি রাজনীতিতে এসেছি। দলের জন্য আমাদের পরিবারের ত্যাগ নেত্রী অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন।’

এদিকে, দলীয় কোন্দল যদি প্রকট আকার ধারণ করে হয়তো বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীকে নৌকা নিয়ে ফটিকছড়ির নির্বাচনী মাঠে দেখে যেতে পারে। স্ব-পরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার পর মোশতাকের সামনে প্রতিবাদ করে তিনি চরম নির্যাতনের শিকার হন। সেই নির্যাতনের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন নুরুল আলম চৌধুরী।

অন্যদিকে ফটিকছড়ি আসনে বিএনপির সর্বশেষ সংসদ সদস্য ছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়ার পাশাপাশি সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর আসনটি চাপিয়ে দেন খালেদা জিয়া। নিজ আসন রাঙ্গুনিয়ায় পরাজিত হলেও ফটিকছড়ি থেকে বিজয়ী হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০০৮ এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সালাউদ্দিন পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৩৩ ভোট। পরাজিত আওয়ামী লীগের পেয়ারুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ২৬৬ ভোট।

আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে থাকা সাংবাদিক নেতা কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘দলের হাই কমান্ড আমাকে দল গোছাতে বলেছেন। সেই নির্দেশ মোতাবেক আমি চেষ্টা করছি।’ নির্বাচনে মনোনয়ন নিশ্চিত কিনা— প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে এসেছি মানবসেবার ব্রত নিয়ে। এমপি হব কিংবা মন্ত্রী হব এমন লক্ষ্য নেই। তবে তা হলে সেবার পরিধি বৃহৎ হবে। বৃহৎ পরিসরে মানবসেবার চ্যালেঞ্জ নিতে আমি প্রস্তুত।’

বিএনপির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী নির্বাচনকে ঘিরে ফটিকছড়িতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ফটিকছড়ি একটি অবহেলিত জনপদ। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি এখানে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন পেলে এখানে বিজয়ী হবে ধানের শীষ।’

ধানের শীষের প্রার্থী হতে ইচ্ছুক সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চূড়ান্ত থাকলেও তিনি দলের চেয়ারপারসনের নির্দেশে ছাড় দিয়েছিলেন। এবার নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া তার ওই ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন।

এদিকে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী অথবা ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর নামও শুনা যাচ্ছে চট্টগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য পদে। তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক সূত্র জানিয়েছেন, নির্বাচনে অংশ নিতে তাদের আগ্রহ নেই।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চট্টগ্রাম,আ.লীগ,চট্টগ্রামের রাজনীতি,আ.লীগের কোন্দল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close