প্রতীক ইজাজ

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

জাতীয় ঐক্যের ৫ দাবি : কোনো নতুনত্ব নেই

যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম ঘোষিত জাতীয় ঐক্যের পাঁচ দফা দাবি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনায় মুখর দেশের রাজনীতি। গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দাবি উত্থাপনের পর থেকেই তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ চলছে নানা মহলে। একদিকে যেমন এই পাঁচ দাবির মধ্যে চারটিরই কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, অন্যদিকে এসব দাবির মধ্যে কোনো নতুনত্ব দেখছে না রাজনৈতিক মহল। বরং ঘুরেফিরে নির্বাচনের সেই পুরনো ইস্যুগুলোই উঠে এসেছে।

সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনী রাজনীতির শুরু থেকেই জানিয়ে আসা বিএনপির এসব দাবি এখন পর্যন্ত কোনো ভিত্তি পায়নি। উপায়ান্তর না পেয়ে দলটি এখন বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছে। এমনকি জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব দাবি নিয়ে অনেক আগে থেকেই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। একদিকে ক্ষমতাসীনরা বলছে, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনকালীন তার নেতৃত্বাধীন সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। অন্যদিকে, বিএনপির দাবি, সংসদ ভেঙে ‘সহায়ক সরকার’-এর অধীনে নির্বাচন। জাতীয় ঐক্যের অন্য তিন দাবির ক্ষেত্রেও বিএনপি একই অবস্থান নিয়েছে।

গত শনিবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে। এগুলো হলো— সংসদ ভেঙে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয় সরকার গঠন, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোটের সময় বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধন। এ ছাড়া কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি এবং এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করার দাবিও জানানো হয়।

সরকার ও আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যকে স্বাগত জানালেও ঐক্যের এসব দাবি অসাংবিধানিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ। এমনকি নির্বাচনকে সামনে রেখে মিথ্যাচার, সহিংসতায় উসকানিমূলক গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি করে দেওয়া হয়েছে।

গত শনিবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, তারা রাজনীতি করুক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটা প্ল্যাটফর্ম তো থাকা দরকার। কিন্তু অন্য কিছু ভাবলে তাদের আশা পূরণ হবে না। এমনকি এই জোটের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করুক। আমি কমিশনারকে (ডিএমপি কমিশনার) অনুরোধ করব। এ সময় তিনি আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকার গঠন, বিচারিক ক্ষমতায় দিয়ে সেনা মোতায়েন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের দাবিগুলো অপ্রাসঙ্গিক, অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় ও অসাংবিধানিক বলে মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংসদের শেষ অধিবেশন ২০ অক্টোবরের আগেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর আর নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ বসবে না। এ সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষমতা ও কার্যকারিতা থাকবে না। তবে জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োজন হলে সেনা মোতায়েন হবে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে, সরকার প্রয়োজনে এবং বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে কীভাবে মোতায়েন হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান। এমনকি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের সময় এখন নেই উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে তো বিএনপিরও প্রতিনিধি রয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই রাষ্ট্রপতি এ নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর মতো নতুন নতুন জোটকে স্বাগত জানান।

একইভাবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও জাতীয় ঐক্যের পাঁচ দফা দাবিকে সংবিধান পরিপন্থী বলেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট আছে, বিএনপির নেতৃত্বে জোট আছে। বি চৌধুরী ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যদি আরেকটি জোট হয় এটাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তারা যে প্রস্তাব করেছেন সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ নির্বাচন হবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সংবিধান অনুসারে এবং নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তারিখে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, সংবিধানের বাইরে যাব না।

অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য পক্ষান্তরে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে মেনে নিচ্ছে বলে মত দিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। গত শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য নামধারীরা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে থাকবে বলে জাহির করলেও তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করছেন। আর বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করা মানেই স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য গড়া। কারণ বিএনপি হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের মুদ্রার অন্যপিঠ। বিএনপি কখনোই জামায়াত ছাড়া চলবে না। কাজেই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য মানেই জামায়াতকে মেনে নেয়া।

সংবিধানে জাতীয় ঐক্যের মূল চার দাবির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবেÑ কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন বা থাকবেন না- এ ব্যাপারে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে যেরূপ স্থির করিবেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।’ ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে তাহার সংখ্যার অনূন্য নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন।’ একই অনুচ্ছেদের দুই উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’

নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারেন। যদি তিনি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারান অথবা রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের জন্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন কাউকে না পান, কেবল ওই কারণেই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন কাউকে পাওয়া গেলে মেয়াদ অবসানের একদিন আগেও রাষ্ট্রপতির সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তবে ওই সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না।

এমনকি নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি সংবিধানের এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই বলেও জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে। ফলে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। কোনো কারণে যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেন তাহলেও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্থাভাজন কাউকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

একইভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী সেনা মোতায়েনে বিএনপির দাবির কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর কথা নেই। ২০০৯ সালে আরপিও সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, তারা ক্যাম্পে অবস্থান করবে, প্রয়োজনে তাদের ডাকা যাবে।

জাতীয় ঐক্যের মতো এর আগে বিএনপিও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানালেও তা আমলে নেননি ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতাসীনদের দাবি, এ কমিশন গঠনের সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠিত হয়েছে। সার্চ কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশনারদের নামের তালিকা পর্যন্ত দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দাবি তুললেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বদলানো যায় না।

সরকার ইভিএম চাপিয়ে না দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের কথা বলে আসছে শুরু থেকেই। এ ব্যাপারে গত ২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ এটা প্রাকটিসের ব্যাপার। আমাদের পরীক্ষামূলক করে দেখতে হবে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে চালুর পর এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেই কেবল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য ইসি ইতোমধ্যে নির্বাচনী আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের একটি পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পেলেও সিইসি বলেছেন, তারা এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় ঐক্য,একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন,যুক্তফ্রন্ট-গণফোরাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close