প্রতীক ইজাজ

  ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনই সরব ২ বড় দল

নির্বাচনী রাজনীতির পালে হাওয়া

আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ৩১ অক্টোবরের থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ক্ষণ-গণনা শুরু হবে। সে সময়কে বিবেচনায় রেখে সেপ্টেম্বর খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। যদিও অক্টোবরেই সব কিছুর চূড়ান্ত হবে; কিন্তু সেপ্টেম্বরেই সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন-সংক্রান্ত অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

একদিকে যেমন এসব ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামাল দিতে হবে; তেমনি সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামতে হবে দলগুলোকে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, দলের মনোনয়ন চূড়ান্ত, সর্বশক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে নামা, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিরসনে দলকে প্রস্তুত রাখাসহ এমনতর নানা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে এ মাসেই। বিশেষ করে বিভিন্ন জোটকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী রাজনীতি ঠিক কোন পথে এগোয়, তাও স্পষ্ট হবে এ মাসে। ফলে এ মাসই হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ সময়।

এমন আভাস মিলেছে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন গতকালই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির পালে হাওয়া লেগেছে। গতকাল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে থেকে জোটগতভাবে সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রচারণার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন ১৪ দলের নেতারা। এমনকি নির্বাচন বানচালে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া কিছুতেই নির্বাচনে যাবে না বলে গতকাল দলের সমাবেশ থেকে জানিয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক দাবি পূরণ ব্যতিরেকে কোনো প্রকার নির্বাচন হবে না বলেও হুমকি দিয়েছেন দলের নেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই নির্বাচনী পালে হাওয়া লাগার পাশাপাশি নির্বাচনী রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নির্বাচনের বেশি সময় নেই। ৩১ অক্টোবর থেকে ক্ষণ-গণনা শুরু হবে। নির্বাচনও হবে। মুখে যে যেমন কথাই বলুক না কেন, নির্বাচন না হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি দেশে নেই। সুতরাং, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে দলগুলোকে। উত্তেজনা দেখা দেবে। আবার প্রশমিতও হবে। তবে সব দলকে সংযত থেকে, যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েই নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, এখন পর্যন্ত যা কিছু আলোচনায় সবই রাজনীতি ও নির্বাচনের অংশ। এসব এ দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিও। তবে এর জন্য সবাইকে সহনশীল হতে হবে। এবার নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো সংকট নেই। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করবে। সরকার সহযোগিতা করবে। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকার হবে। সেখানে সংকট তৈরির সুযোগ নেই। তবে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হতে পারে।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমনও বলেন, এবার বিএনপিকে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নতুবা নির্বাচন কমিশনে ওই দলের নিবন্ধন বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। সংবিধানের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে অযৌক্তিক কোনো দাবি পূরণে তারা সরকারকে চাপও দিতে পারবে না। আর নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে নানা ধরনের আলোচনা থাকে। আশা করছি সব সংকটের সমাধান হবে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ মাসেই সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাধানে যেতে হবে। সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ মাসেই। যদিও সরকার বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে অক্টোবরে; কিন্তু এর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এ মাসেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের মধ্যে সাংগঠনিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব লেগেই রয়েছে। দলীয় মনোনয়ন নিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, নির্বাচন হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও দলকে সে হিসেবেই প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিএনপিও এবার নির্বাচনে যাবে বলেই ধারণা। সুতরাং, নির্বাচনী মাঠ দখলে সর্বশক্তি নিয়ে এ মাসেই মাঠে নামতে হবে ক্ষমতাসীনদের। বিশেষ করে একেবারে শেষের দিকে এসে জোট রাজনীতি ক্ষমতাসীনদের কিছুটা হলেও ভাবনায় ফেলেছে। যুক্তফ্রন্ট ও সামনে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে যে জাতীয় ঐক্য তৈরির কথা বলা হচ্ছে, সেই জোট ও ঐক্য সর্বশেষ কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় ও ধরনের জোট রাজনীতিকে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে সামাল দেয়, তারও অনেকটাই স্পষ্ট হবে এ মাসেই।

অন্যদিকে, এবার নির্বাচনে বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতির মামলায় কারান্তরীণ দলের চেয়ারারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি। যদিও বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে কোনো নির্বাচন নয়; কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে শেষ পর্যন্তু নির্বাচনের আগে মুক্তি না পেলে তাকে রেখেই নির্বাচনে যেতে হবে বিএনপিকে। এমনকি এ মাসেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। সেক্ষেত্রে দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ দলের অনেক শীর্ষ নেতার সাজা হতে পারে। এই পরিস্থিতিকে বিএনপি কীভাবে সামাল দেবে, তাও বোঝা যাবে এ মাসে। দলকে সুসংগঠিত করে বিএনপি নির্বাচনী মাঠে কতটা শক্তভাবে অবস্থান নিতে পারে সেটাও দেখার বিষয়। এমনকি মনোনয়নের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা রয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে থাকছে কি না- তার ওপরও নির্ভর করবে দলটির নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি।

অবশ্য এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই দলই তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচন বানচাল করে অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো অশুভ চক্রান্ত রুখতে ১৪ দল সজাগ আছে। এ সময় পর্যায়ক্রমে সারা বাংলাদেশে বিভাগীয় সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীনরা। এ ব্যাপারে গতকাল ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করবে। নির্বাচন কমিশন তার নীতি অনুযায়ী, সবাইকে সমান সুযোগ দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বর্তমান সরকারের অধীনেই সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, বিএনপির লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলের মধ্যে চাপ আছে। সে লক্ষ্যে সরকারবিরোধী অন্য রাজনৈতিক দল নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি ও খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। তবে কিছুতেই বিএনপিকে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে বিএনপিতে বিভক্তি আসে কী না, সেদিকেও সরকারি দলের দৃষ্টি আছে। সরকারবিরোধীরা যাতে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, সেই চেষ্টাও আছে আওয়ামী লীগের।

এ মাসেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। দলীয় সূত্রমতে, প্রায় শতাধিক এমপি আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন। কিছুতেই বিতর্কিত ও জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে না। এ জন্য অনেক আগে থেকেই জরিপ চালানো হয়েছে। আসনভিত্তিক জরিপের কাজ প্রায় শেষ। কোন এলাকায় কার অবস্থান ভালো সে বিষয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এটি এখন নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। একইভাবে সম্ভাব্য দলীয় কোন্দল, ভোটের আগে দলবদল ও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে ক্ষমতাসীনরা।

এসব ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দেশে নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়ে গেছে। এ মাসে আরো বাড়বে। তবে এটা বলে রাখি, সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের যে রূপরেখা ২০১৩ সালে চালু হয়েছে, এবারও তা-ই করা হবে। অক্টোবরেই এই সরকার হতে পারে।

অন্যদিকে, গতকালও নির্বাচনকে ঘিরে বেশকিছু দাবিও কথা জানিয়েছে বিএনপি। দলের নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সেনা মোতায়েন করতে হবে। এ ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো।

বিএনপি দলীয় সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সামর্থ্য অনুযায়ী, আন্দোলন করবে দল। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। খালেদা জিয়া যে শিগগির মুক্তি পাচ্ছেন না, এমন ইঙ্গিত দল পেয়েছে। একইসঙ্গে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় বেশ বিপাকে ফেলবে দলকে। ফলে এখনো নির্বাচনের ব্যাপারে ঠিক অতটা প্রস্তুতি নিতে পারেনি দল।

দলীয় সূত্রমতে, দল গোছানো ও দলকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতির কাজ একসঙ্গে চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে মাঠপর্যায়ের নেতাদের বার্তা পাঠানো হয়েছে। নেতাকর্মীদের চাঙা করতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণা করা হবে শিগগির।

দলীয় সূত্রগুলো আরো জানায়, বিএনপি চায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ হোক। সরকার যদি কিছুটা ছাড় দেয় বিএনপিও একই অবস্থানে বসে থাকবে না। কিন্তু সরকার এগিয়ে না এলে বিএনপি তার অবস্থানেই থাকবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করে নির্বাচনে যাবে বিএনপি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি বড় দল। নির্বাচনমুখী দল। সুতরাং, সব নির্বাচনের প্রস্তুতিই থাকে। তবে এবার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নির্বাচনে যাব। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি,নির্বাচনী রাজনীতি,জাতীয় সংসদ নির্বাচন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close