কাইয়ুম আহমেদ

  ১৩ জুলাই, ২০১৮

কারলাইলকে নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি

ঢুকতে দেয়নি ভারত : দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ফেরত

দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশি আইনজীবী লর্ড কারলাইলকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় উঠেছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বাংলাদেশের এমনকি পাশের দেশ ভারতেরও রাজনীতি। আওয়ামী লীগ বলছে, কারলাইলের কর্মকান্ড ছিল নিয়মবহির্ভূত। বাংলাদেশে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ঢুকতে চেয়েও পারেননি। একই কায়দায় তিনি ভারতে ঢুকতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। আর বিস্মিত ও মর্মাহত হওয়ার কথা বলছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্ত চিন্তা অনুশীলনের সঙ্গে এই ঘটনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এদিকে, ব্রিটিশ এই আইনজীবীর তাদের দেশে প্রবেশকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছেন, কারলাইল চাইছিলেন ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে। তিনি সফরের উদ্দেশ্য গোপন রেখে ভারতে আসতে চেয়েছিলেন। তবে আজ শুক্রবার নয়াদিল্লিতে ‘ফরেন করেসপন্ডেন্ট ক্লাবে’ খালেদার দন্ড নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেওয়া কারলাইলের অভিযোগ, তাকে ঢুকতে না দিয়ে বাংলাদেশের চাপে নতি স্বীকার করেছে ভারত। দেশটির গণতন্ত্রের প্রতি তার শ্রদ্ধা শেষ হয়ে যাওয়ার কথাও বলেন গত বুধবার দিল্লি বিমানবন্দরে নামার পর উপযুক্ত ভিসা নিয়ে না আসার কারণে ফেরত যাওয়া এই ব্রিটিশ আইনজীবী।

বছর তিনেক আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় আসেন কারলাইল। আর বাংলাদেশে তিনি আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়ের পর বিবৃতি দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনাও করেন।

এ কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা কার্লাইলকে বর্ণনা করেন ‘জামায়াতের লবিস্ট’ হিসেবে। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কার্লাইল বলেছিলেন, আইনের মানদন্ডে নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে খালেদা জিয়ার সাজার রায় হয়েছে।

এদিকে, কার্লাইলকে ঢুকতে না দেওয়ার ভারতের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নেতাদের ভাষ্য, একটি দেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে আরেক দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ কেউ পেতে পারে না। এ কারণেই ভারত তাকে ঢুকতে দেয়নি।

আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, কার্লাইল বাংলাদেশেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ঢুকতে চেয়ে অনুমতি পাননি। একই কায়দায় তিনি ভারতে ঢুকতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, কার্লাইল টুরিস্ট ভিসায় ভারত এসেছিলেন। এই ভিসায় কোনো দেশে প্রবেশ করে সংবাদ সম্মেলন করার এখতিয়ার কারো নেই।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, লর্ড কার্লাইল যে ইনটেনশন নিয়ে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন সেটা নিয়মবহির্ভূত ছিল। ফলে তাকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এজন্য ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানাই আমরা।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, লর্ড কার্লাইলকে ভারত ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগ দেশটির সরকারকে সাধুবাদ জানায়।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, লর্ড কার্লাইলের উদ্দেশ্য ছিল ষড়যন্ত্র। ভারত সরকার তা বুঝতে সমর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যেমন আমাদের ভূখন্ড ব্যবহার করে কাউকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেই না, তেমনি ভারতও তাদের ভূখন্ড ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেয়নি কার্লাইলকে।

অন্যদিকে, গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্রিটিশ ‘হাউস অব লর্ডস’ এর সদস্য কার্লাইলকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। ভারতের মুক্ত চিন্তা অনুশীলনের সঙ্গে এই ঘটনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে এদেশে গণতন্ত্র অনুশীলনে যে বাধা সৃষ্টি করেছে তার প্রতিবাদ জানানোর জন্য কার্লাইল দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ভিসা না দেওয়ার কারণেই কার্লাইল ভারতে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে ভারতে ঢুকতে না দেওয়ায় আমরা মর্মাহত।

আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, ভারত না হয় ভিসা দেয়নি, কিন্তু কার্লাইল বাংলাদেশের ভিসা কেন পেলেন না? তাকে কেন আসতে দেওয়া হলো না? আমি সরকারের কাছে জবাব চাই। এখানে তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার অবহেলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক এক আলোচনায় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগে গত ৮ জুলাই ২০১৮ রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন ‘লর্ড কার্লাইলকে ভিসা না দেওয়া হলে এটা প্রমাণিত হবে যে, খালেদা জিয়াকে কারাদন্ড দেওয়ার পেছনে ভারতীয় হাইকমিশনের ভূমিকা রয়েছে।’

রিজভী বলেন, শুক্রবার ফরেন করেসপন্ডেন্ট ক্লাবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ও কারাদন্ডের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য দেওয়ার কথা। যদি ঢাকার হাইকমিশনের সুপারিশে কার্লাইলকে ভিসা না দেওয়া হয়, তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাদন্ড দেওয়ার পেছনে ভারতীয় হাইকমিশনের ভূমিকা রয়েছে।’

এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার গতকাল অভিযোগ করে বলেছেন, কার্লাইল দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে চাইছেন এমন মনে করার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে। সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন রেখে তাই তিনি ভারতে আসতে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই তার ভিসা বাতিল করা হয় এবং তাকে বুধবার রাতে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

রবীশ কুমার বলেন, কার্লাইলের উদ্দেশ্যই ছিল ভিন্ন। তিনি চাইছিলেন ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করাতে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিরোধী দলের সঙ্গে ভারতীয় নেতৃত্বের। রবীশ জানান, যখনই ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশ সফর করেছেন, তা তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোন কিংবা প্রধানমন্ত্রী, সবসময় বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আলোচনা করেছেন। কার্লাইল সেই সম্পর্ক নষ্টের চেষ্টায় ছিলেন। মুখপাত্র বলেন, পড়াশোনার ভিসা নিয়ে কেউ যেমন চাকরি করতে পারেন না, তেমনই বিজনেস ভিসা নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার করা যায় না। দিল্লি এসে যা তিনি করতে চাইছিলেন, লন্ডনে বসেও তা করতে পারতেন। রবীশ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দেশের আইন মানতে সবাই বাধ্য।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার জানিয়ে দেন, লর্ড কার্লাইল যে কারণ দেখিয়ে ভিসার আবেদন করেছিলেন, আর তার সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য—এসবের মধ্যে কোনো সাযুজ্য নেই বলেই আমরা তার ভিসা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তবে গতকাল লন্ডন ফিরে গিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে কার্লাইল পাল্টা জানান, ভারতের লজ্জিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক চাপের মুখে যেভাবে তারা নতি স্বীকার করল, ৭০ বছর বয়সী এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে যে আচরণ করল, তার কৈফিয়ত দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ভারতের গণতন্ত্রের প্রতি তার যাবতীয় শ্রদ্ধা শেষ হয়ে গেছে। কার্লাইল জানান, তাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটল, তা নিয়েও তিনি শিগগিরই লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করবেন।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী কার্লাইলকে নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতি সরগরম। বাংলাদেশ তাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না বলে ভারতে গিয়ে তিনি দেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতির ‘অবস্থা ব্যাখ্যার’ উদ্যোগ নেন। লন্ডন থেকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন খালেদা জিয়াকে ‘সাজানো মামলায়’ ফাঁসানো হচ্ছে ও হেনস্তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ বলেই তিনি ভারতে বসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু

সার্ক সনদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে এতে বাংলাদেশ বেঁকে বসে। এর পর ভারতও নড়েচড়ে বসে। সরকারিভাবে বৃহস্পতিবার বলা হয়, কার্লাইলের ভিসা যে বাতিল করা হয়েছে তা তাকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুধবার রাতে কার্লাইল ভারতে আসেন। তার আগে দিল্লির ‘ফরেন করেসপন্ডেটস ক্লাব’ (এফসিসি) তাকে সময় দিয়েছিল। বাংলাদেশের আপত্তি ও ভারতের চাপে (এফসিসি) তা বাতিল করে দেয়। কার্লাইল তখন ঠিক করেন, রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করবেন। কিন্তু দিল্লি নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানানো হয় তার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। পরে লন্ডনে ফিরে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, দিল্লি নামার পর দেখি মোবাইলে ভিসা বাতিলের বার্তা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনীতি,লর্ড কারলাইল,আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist