বদরুল আলম মজুমদার

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

বিএনপির হঠাৎ নড়াচড়া

চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করতে হঠাৎ করেই রাজপথে সরব হয়ে উঠেছে বিএনপি। ৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারপারসনের কারাবরণের পর মাসখানেক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলেও এখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে দলটি। গত দুই সপ্তাহ থেকে খালেদার স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার ও বিএনপির পাল্টা-পাল্টি অবস্থান রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ নিয়ে আসে। এরই মাঝে গত দুই মাসের আন্দোলনকালীন গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশ নেতা জামিনে বেরিয়ে আসেন। বিশেষ করে দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জেল থেকে বের হওয়ার পরই নতুন নতুন কর্মপন্থা নির্ধারণে বেশ তৎপর দেখা যাচ্ছে দলকে। তাছাড়া দলের লন্ডন প্রবাসী নেতা তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো অবস্থানও বিএনপিকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ অবস্থায় দলের স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকটি বৈঠকে বিএনপিকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং দাবি আদায় পর্যন্ত মাঠে থাকার নীতিগত সিন্ধান্ত হয়। আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে জুন পর্যন্ত মাঠে সরব থাকার চিন্তা করছে বিএনপি।

দলীয় সূত্র জানায়, কারাগারে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিএনপি। কয়েক দিন আগে দলের তিন সিনিয়র নেতা ও আত্মীয়স্বজনকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ৭ দিনের শান্তিপূর্ণ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। পাশাপাশি সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ইউনাইটেডসহ বিশেষায়িত কোনো হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন দলের দুই সিনিয়র নেতা।

এদিকে লন্ডন সফররত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসী বাঙালিদের এক অনুষ্ঠানে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমানকে দেশে ফেরত আনার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। যে অপরাধী সাজাপ্রাপ্ত সে কী করে এখানে থাকে? কাজেই তাকে তাড়াতাড়ি ফেরত দেন। ফেরত নেয়ার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। যেভাবেই হোক দেশে আমরা ফেরত নেব। এমন ঘোষণায় বিএনপি নেতারা অনেকটা উদ্বিগ্ন। যদিও দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য তারেকের দেশে ফেরত আনার বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো জোরালো বক্তব্য আসায় নতুন করে হিসাব করতে হচ্ছে বিএনপিকে। এছাড়া দেশের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন তারেক এমন তথ্য উঠে আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। লন্ডনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এমন তথ্যের পর গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন এমন তথ্য প্রমাণ থাকলে উপস্থাপন করুন। পরে শাহরিয়ার আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সাংবাদিকদের কাছে পাসপোর্টের কিছু পাতা সরবরাহ করেন।

এদিকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনতে আলোচনা চলছে। গত রোববার রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে জেলা ও দায়রা জজ এবং সমপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এক প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকলেও এ চুক্তি করতে তো বাধা নেই। এখন মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্ট অ্যাক্ট বলে একটা আইন আছে। সেখানে কিছু কিছু অপরাধীর বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু আনতে পারি। সেই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্ট অ্যাক্ট আমাদের দুই দেশেরই আছে। এটা কিন্তু জাতিসংঘের ধার্যকৃত একটা আইন।

সরকারি দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, তারেক রহমান দেশে আসবেন এজন্য তো কারো ওস্তাদি করার দরকার নেই। এটা তো খুব বড় একটা কাজ না। তারেক রহমান অবশ্যই আসবেন। খালেদার মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা জাগতে শুরু করেছে। অবশ্যই দেশমাতা মুক্তি পাবেন। দেশের গণতন্ত্র ফিরতে শুরু করলে সরকারও পালাতে থাকবে। যা এ উপমহাদেশে বার বার প্রমাণিত। সেটির জন্য আমাদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

এদিকে তারেক রহমানের পাসপোর্ট সারেন্ডার করা হয়েছে এমন প্রমাণ দিতে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে উকিল নোটিশ পাটানো হয়েছে প্রতিমন্ত্রীকে। তারেক রহমানের পক্ষে পাঠানো নোটিশে বলা হয়, আগামী ১০ দিনের মধ্যে প্রতিমন্ত্রীকে বক্তব্যের প্রমাণ দিতে হবে, ব্যর্থ হলে তারেক রহমানসহ জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এছাড়া বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইনি নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখানোর কথা বলে ক্ষমতাসীন দল থেকেও একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। সে বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান গতকাল গণমাধ্যমে বলেন, ‘না, আমরা দেখাব কেন? বিতর্ক যারা তুলেছে তাদের দায়িত্ব দেখানোর যে তিনি এ দেশের নাগরিক নন বা পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন। এটা তো তারা দেখাবেন, আমরা দেখাব কেন? তারা বিতর্ক তুলবেন, আমরা বিতর্কে অংশ নেব নাকি? আমাদের তো বিতর্কে অংশ নেয়ার দরকার নেই। তারা যেহেতু বিতর্কটা তুলেছেন প্রশ্নটা তাদের করেন যে, আপনারাই বিতর্ক তুলেছেন, বিএনপি তোলেনি, সুতরাং আপনারাই দেখান তারেক রহমান পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন তারেক রহমান। এক-এগারোর সময়ে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানে অবস্থান করে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।

এদিকে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে মহানগর দক্ষিণ বিএনপি। মিছিলটি দৈনিক বাংলার দিকে এগোতেই পুলিশের লাটিচার্জের মুখে পন্ড হয়ে যায়। এ সময় বিএনপি ও অঙ্গ দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মিছিল করতে না পেরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে। বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের মতিঝিল জোনের এডিসি শিবলী নোমানসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলাকালে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায় পুরানা পল্টনে।

এর বাইরে গত রোববার দুপুরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে মধ্য বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিক্ষোভ মিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মির্জা আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ। সেখানে তাকে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। আমরা দেশনেত্রীকে মুক্তি দিয়ে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

গত শনিবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপি স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দলের দুই সিনিয়র নেতা। বৈঠকে তারা খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানান। এর আগে গতকাল সকালে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ৭ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আগামী ২৫ এপ্রিল ঢাকাসহ সারা দেশে মহানগর ও জেলা সদরে মানববন্ধন এবং ২৭ এপ্রিল কারাবন্দি খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনায় মসজিদে মসজিদে বাদ জুমা দোয়া মাহফিল করবে বিএনপি। ২২ এপ্রিল ঢাকা মহানগর উত্তর, ২৩ এপ্রিল মহানগর দক্ষিণ, ২৬ এপ্রিল ছাত্রদল, ২৮ এপ্রিল যুবদল ও ২৯ এপ্রিল স্বেচ্ছাসেবক দল সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি করবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,রাজনীতি,আন্দোলন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist