প্রতীক ইজাজ

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

খালেদা জিয়ার ৬ শর্ত

নানা আলোচনা রাজনীতিতে

প্রতীকী ছবি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির ছয় শর্ত নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনীতিতে। সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে—এমন শর্তগুলো নিয়ে ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শর্তগুলো কতটুকু সংবিধানসম্মত ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; তা নিয়ে যেমন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, তেমনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে কীভাবে দেখছে সরকার ও ক্ষমতাসীনরা—সেদিকেও তাকিয়ে সবাই। বিশেষ করে এসব শর্ত পূরণে সরকারকে কেবল কি সংবিধানেই ওপরই নির্ভর করতে হবে; নাকি সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে—এমন বিষয়ও জানতে চান সবাই।

এমনকি খালেদা জিয়ার দেওয়া ছয় শর্ত নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিভিন্ন মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েছে দলটি। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, পুনরায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বললেও এখন পর্যন্ত সেই সরকারের কোনো রূপরেখা দেয়নি দলটি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করলে বিএনপি কেবল সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছে। কিন্তু নির্দলীয় সরকারের কাঠামো কী হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করা হয়নি। সর্বশেষ গত শনিবার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকেও এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেও জোরালো কোনো প্রত্যয় ব্যক্ত করেননি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর ফলে নির্বাচনী রাজনীতিতে এসব শর্তের স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শনিবার নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া ছয় শর্ত জুড়ে দেওয়ার পরপরই তা নিয়ে বাগবিতন্ডায় জড়ান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা। সমালোচনামুখর হয়ে পড়ে রাজনীতি। খালেদা জিয়ার কোনো শর্তই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের মতে, খালেদা জিয়ার দেওয়া দফাগুলোর কানাকড়ি মূল্যও নেই। তিনি নির্বাচন ভন্ডুল করতেই ট্রেড ইউনিয়ন নেতার মতো এমন সব দফা দিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের একটি শর্তও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তিনি যত শর্তই দেন না কেন, তিনি এবং তার দল বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। ওই সময়ে জাতীয় সংসদও বহাল থাকবে। তিনি আরো বলেন, কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যা কিছু করার প্রয়োজন হবে, তার পুরোটাই সংবিধানের ভেতরে থেকেই করা হবে। তা ছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।

অন্যদিকে, বিএনপিদলীয় সূত্রমতে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। সেজন্যই নির্বাচন ভন্ডুল হতে পারে—এমন উসকানিমূলক কথা খালেদা জিয়া সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করেছেন। কারণ দলের কাছে খবর আছে যে, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার এক ধরনের কৌশল সরকারের রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারে রূপরেখা ঘোষণা করা হচ্ছে না কেন-জানতে চাইলে দলীয় নেতাদের মতে, খালেদা জিয়ার দুর্র্নীতি মামলার রায় কেন্দ্র করে সামনের রাজনীতি নির্ভর করছে। সেই অবস্থায় দলের নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়াসহ রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি সামনে রয়েছে। ফলে দলের নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা জিয়ার দেওয়া ওই বক্তব্যই বিএনপির সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থান বলে মনে করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দলীয় চেয়ারপারসনের বক্তব্যই বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান। বর্তমান সংসদ রেখে অথবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ বহাল রেখে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এমনকি নিবন্ধন বাতিল হবে কি না—এই চিন্তা বিএনপি করে না বলেও জানান এই নেতা।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার শর্তগুলো : জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে। নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। জনগণ যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে, সে রকম সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং কোনো ইভিএম চলবে না। এই ছয় শর্তের ব্যাপারে সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে কী আছে ও শর্ত পূরণে সরকারের এখতিয়ারইবা কতটুকু-জানতে গতকাল কথা হয় দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে।

জানা গেছে, ছয় শর্তের মধ্যে ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’ শর্তটি বর্তমান সংবিধান পরিপন্থী। কারণ নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে ও ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে সহায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাঠামো নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে, কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন বা থাকবেন না; তা নির্ধারণের একমাত্র অধিকার প্রধানমন্ত্রীর।

একইভাবে ‘নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে’ শর্তটিও অসাংবিধানিক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। এই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তবে ওই সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না-এমন অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি করেছে, সংবিধানে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে সংবিধানে বলা আছে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে। ফলে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। কোনো কারণে যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেন তাহলেও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্থাভাজন কাউকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

অন্যদিকে, নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা (ম্যাজেস্ট্রেসি পাওয়ার) দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও ইভিএম বাতিলের যে দুই শর্ত জুড়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া, সংশ্লিষ্ট আইনে এরও কোনো বিধান নেই বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে, ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে মোতায়েনের কোনো বিধান নেই। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৩ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আরপিওতে সংশোধনী এনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়। পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলো সংশোধনের সময়ও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সেনাবাহিনী। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম ও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে সেনাসদস্যরা নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থাৎ এ সময়ে তারা পুলিশের মতো পরোয়ানা ছাড়াই অপরাধীকে গ্রেফতার করে থানায় সোপর্দ করার সুযোগ পেয়েছেন।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাস্তবে সেনাবাহিনীর হাতে কখনোই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার সুযোগ নেই। অতীতেও ছিল না। তারা না বুঝেই এসব কথা বলছেন।

আর নির্বাচনে ইভিএম থাকছে না বলে জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রস্তুত নয়। এ কারণে ওই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। তবে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি, আমরা জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জন্য ইভিএম নিয়ে প্রস্তুত নই। এটা আমরা স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালাব। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম প্রয়োগ করার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত নই।’

অন্যদিকে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির যে শর্ত বিএনপি পরোক্ষভাবে তুলেছে, সে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয় বলে এর আগে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শেষে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না, সে দায়িত্ব কমিশনের নয়। এখতিয়ারও নেই। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করবেন তারা। কারণ সরকার যেভাবে বলবে, ইসি সেভাবে নির্বাচনের আয়োজন করবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার ক্যলাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা আছে। সমান মাঠেই খেলা হবে। নির্বাচন কমিশন রেফারির দায়িত্ব পালন করবে। সব দলের জন্য সমান সুযোগ থাকবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন,রাজনীতি,আওয়ামী লীগ,বিএনপি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist