বিশেষ প্রতিনিধি

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

আলোচনায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

বারবার সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ও দলীয় ফোরামেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে—দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার এমন ইঙ্গিতে সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপিও। দলের শীর্ষ নেতারাও বিভিন্ন সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

গত বছর নির্বাচন নিয়ে সংলাপ শেষে নির্বাচন কমিশনও এমন নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে আসবে- বিভিন্ন সময় এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। এমনকি গত বছরের শেষের দিকে ও এ বছরের শুরুতে নির্বাচনী রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আভাস দিয়েছেন।

সর্বশেষ গতকাল সিইসি কে এম কে এম নুরুল হুদার এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। সেক্ষেত্রে এমন নির্বাচনের জন্য বিএনপির অংশগ্রহণকে অপরিহার্য বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, বিএনপি একটি বড় দল, তাদের ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণ হয় কী করে? বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না।

এর ফলে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আবারও সামনে চলে এল। বিশেষ করে ‘বিএনপিকে ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়’ সিইসির এমন বক্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দিল। ক্ষমতাসীনদের মতের বিপক্ষে অবস্থান নিল সিইসির এই বক্তব্য। কেননা ক্ষমতাসীনরা আগে থেকেই বলে আসছে সংবিধান মেনে বিএনপি নির্বাচনে আসবে এবং বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আলাদা কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। এমনকি সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণার সময় নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে বিএনপির দাবি অসাংবিধানিক ও গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন।

এমনিতেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিএনপি। দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও এনেছে। গতকালও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার আরো একটি বিতর্কিত নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। এর পাল্টা জবাবে সেতুমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য বিএনপি নানা ধরনের ‘টালবাহানা’ করছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির কাজকর্ম দেখে, তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার টালবাহানা করছে। এজন্য তারা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে।

ফলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে অপরিহার্য বলে দেওয়া সিইসির বক্তব্য নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিল। সিইসির বক্তব্যের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, সিইসি কি ভেবে এমন বক্তব্য দিয়েছে জানি না। তবে আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। সংবিধান মেনে আসতে হবে। তা না হলে তাদের নির্বাচনে আনতে আলাদা কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। তবে বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হবে না—তা ঠিক নয়। বিএনপি নিশ্চয় একমাত্র রাজনৈতিক দল নয়। আরো দল আছে। কিন্তু বিএনপির এই যুক্তি মানতে রাজি নয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি বড় দল। অবশ্যই এই দলকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এবার বিএনপি জয় পাবে। সেটা বুঝতে পেরেই সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছে।

সিইসি বিএনপিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য ভাবলেও সে শর্ত মানতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে এলে অংশগ্রহণমূলক হবে, না এলে হবে না, ২০ দলীয় জোট নেতাদের এমন ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করছেন ক্ষমতাসীন দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে আগামী নির্বাচনে চায়। এজন্য সব দলের প্রতি আহ্বানও থাকবে। সেই আহ্বান সবার জন্য একই রকম হবে। একটি বিশেষ দলের জন্য আলাদা কোনো পদক্ষেপ নেবে না সরকার। আওয়ামী লীগ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলটির এমন মনোভাব জানা গেছে।

তবে বিএনপির নীতি নির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে না, এমন কথা বলবে না। তারা মনে করেন, সরকার বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করতে চায়। এবার বিএনপি সেই ফাঁদে পা দেবে না। এ কারণে নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। এজন্য আজ অনুষ্ঠেয় দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিশেষ নির্দেশনা দেবেন খালেদা জিয়া। এজন্য নেতাদের আহ্বান জানানো হবে।

এর আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ার অভিযোগ এনে বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সেবার আলোচনা করতে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সাড়া না পাওয়ার পর বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করে সরকারের আরেক মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে।

তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদী রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবার আর সরকার একতরফা নির্বাচনের সমালোচনায় যাবে না। বিএনপিও রাজনৈতিক এবং আইনগত ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে সরকার চাইবে বিএনপিকে চাপে রাখতে। আর বিএনপিও চাইবে আন্দোলনের মাধ্যমে যতটুকু দাবি আদায় করা যায়। শেষ পর্যন্ত সব দলই নির্বাচনে আসবে।

বিশেষ করে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে বিএনপিকে এবার নির্বাচনে অংশ নিতে হবে—এমন কথা বলছেন আইনজ্ঞরা। তবে সেখানে কিছু ফাঁকও রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধন করে কোনো দল পরপর দুবার নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধনের অযোগ্য ঘোষণার বিধান সংযোজন করা হয়। সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। তবে পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অনুপস্থিত থেকেও নিবন্ধন বাতিল না হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মূল দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে—তা সরকার চাপিয়ে না দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। একইভাবে বিএনপিরও উচিত হবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়েই নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাাশি গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তবে সংবিধানে এসব ইস্যুর ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান থাকায় এবং এখন পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত এসব ইস্যু কোনো সংকট তৈরি করবে না বলে মত দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই বলে আসছেন এবার নির্বাচন হবে সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। তবে এসব ইস্যুতে যে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি যে কেবল আনুষ্ঠানিকভাবেই হতে হবে, এমনটা ঠিক নয়। সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে পর্দার আড়ালে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যেও।

আইনগত দিক ব্যাখ্যা করে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনে বলা আছে, পরপর দুবার কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি থেকে যায়। তবে এ ব্যাপারে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। কেননা, নিবন্ধন বাতিল হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের। কোনো দল যদি নিজেই নিজেকে বিলুপ্ত করে বা সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে সরাসরি কমিশন ওই দলের নিবন্ধন বাতিল করবে। কিন্তু নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে বাতিলের প্রয়োজন হলে কমিশনকে অবশ্যই দলটির কথা ও নির্বাচনে না যাওয়ার যুক্তি শুনতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনীতি,আওয়ামী লীগ,বিএনপি,নির্বাচন,ইসি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist