প্রতীক ইজাজ

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্বল করতে চায় আওয়ামী লীগ

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায়। নির্বাচন সামনে রেখে এ রায় নিয়ে ভেতরে ভেতরে কৌশলী রাজনীতি আঁটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। রায়কে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির কোনো সুযোগ দিতে চায় না বিএনপি। আবার ক্ষমতাসীনেরাও এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দীর্ঘদিন। এই রায়কে ঘিরে সৃষ্ট রাজনীতির মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচন উতরাতে চায় দলটি। এজন্য দুই দলই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের দিকে হাঁটছে। কিন্তু কী সেই কৌশল?

ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে দুর্বল ও অপ্রস্তুত করার জন্য খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী রাজনীতিতে এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় দলটি। এর মধ্যদিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া, পদক্ষেপ ও আন্দোলনের তীব্রতা কেমন হতে পারে তার একটি পরীক্ষাও হবে বলে মনে করছেন দলের নেতারা। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সিদ্ধান্তে যাবে দল।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির মাঠের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করাই মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে কিছুটা আগেভাগেই মাঠে নামাতে চাইছে বিএনপিকে। রায়কে কেন্দ্র করে দলটি কী ধরনের কর্মসূচি দিতে পারে ও সে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্ষমতা কতটুকু—তার ওপর নির্ভর করে বিএনপির নির্বাচনী রাজনীতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কৌশল আঁটবে ক্ষমতাসীনেরা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো মনে করছে, এই রায়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজা হবে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। আর খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ না-ও নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ভাঙার চেষ্টাও থাকবে ক্ষমতাসীনদের। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া ছাড়াও যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়, সে ক্ষেত্রে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দলের কর্মসূচিকে সুযোগ হিসেবে নেবে আওয়ামী লীগ। জ্বালাও-পোড়াও বা যেকোনো ধরনের কঠোর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মামলা-গ্রেফতারও চালানো হতে পারে। এমনিতেই পুরনো মামলার কারণে মাঠপর্যায়ে বিএনপি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। নতুন মামলায় পড়লে নির্বাচনে শক্ত অবস্থান নিতে হিমশিম খাবে দলটি। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়ের পথ সুগম হবে।

এমনকি খালেদা জিয়ার সাজার পরও যদি বিএনপি নিশ্চুপ থাকে ও কোনো ধরনের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে না নামে, সে ক্ষেত্রে জিয়া পরিবারকে ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হবে। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগেভাগেই দলের নেতাকর্মীদের মাঠে সক্রিয় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এজন্য খালেদা জিয়ার মামলার রায় প্রকাশের আগেই দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতাদের ১৫টি দল গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই গত শুক্রবার চারটি দল মানিকগঞ্জ, বগুড়া, নড়াইল ও ফেনী এবং পরদিন শনিবার আরো তিন জেলায় সফর করেছে। আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সিলেট থেকে বিভাগীয় সফর শুরু করার কথা রয়েছে। এসব কর্মসূচির মূল লক্ষ্য—খালেদা জিয়া পরিবারের দুর্নীতির প্রচার, সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়কে ঘিরে বিএনপি দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। হুশিয়ারি দিয়েছে। তাই তাদের সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা যেন কোনোরূপ সহিংসতা করতে না পারে, সে জন্য প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। এ ছাড়া দলের নেতাকর্মীদেরও সতর্ক করা হয়েছে।

এই রায়কে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, সব রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচনী কৌশল থাকে। পরিকল্পনা থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। এ দলেরও কৌশল আছে। তবে রায় দেবেন আদালত। কী ধরনের রায় দেবেন, তা-ও আদালতের বিষয়। এখানে সরকার বা দলের কোনো হাত নেই। তবে রায়কে ঘিরে যেন বিএনপি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে না পারে, সে জন্য দল সতর্ক রয়েছে। আমাদের প্রস্তুতিও রয়েছে।

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত। সেই রায় নিয়ে চলছে উত্তেজনা। উত্তপ্ত রাজনীতি। রায় কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি হুশিয়ারি দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ। গত বৃহস্পতিবার রায়ের দিন ঘোষণার পর থেকেই উৎকণ্ঠা পেয়ে বসেছে সবাইকে। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে আবারও কি ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি; নাকি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে—সে প্রশ্ন যেমন মুখে মুখে; তেমনি আওয়ামী লীগই-বা কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়, সেদিকেও তাকিয়ে মানুষ।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে বিএনপির মাঠপর্যায়ে শক্তি সম্পর্কে অবহিত হতে চায় দল। এ জন্য বিএনপিকে মাঠে নামানো দরকার। দলের ক্ষমতার দীর্ঘ সময়ে প্রকৃতপক্ষে বিএনপি এককভাবে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তাই বিএনপির প্রতিক্রিয়া প্রকাশ বা আন্দোলনের সক্ষমতার শক্তি জানা ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি। যাতে তারা বুঝতে পারেন নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন কতটা তীব্র ও কী ধরনের হতে পারে।

দলের নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এ পর্যন্ত বিএনপির যত আন্দোলন তার কৃতিত্ব জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালে প্রায় তিন মাসব্যাপী অবরোধের সময়টাতেও বিএনপির নেতাকর্মীদের চাইতে জামায়াত বেশি সক্রিয় ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ঈদের পর বা পরীক্ষার পর আন্দোলনে নামার কথা বললেও মাঠে নামেনি বিএনপি। তাই আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপির প্রকৃত সক্ষমতা কতটুকু—এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই ক্ষমতাসীনদের কাছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনপি আন্দোলনে যাবে। সে সময় বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হলে আগাম প্রস্তুতি রাখতে হবে দলকে। সে জন্য এই মামলার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে আগেভাগেই মাঠে নামাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যদিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপিকে মোকাবিলায় সময় পাওয়া যাবে। দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীনরা এমনও মনে করছেন, মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। আন্দোলনমুখী রাজনীতিতে যাবে দলটি। নতুন মামলা-গ্রেফতারে পড়বে দলের নেতারা। পুরনো মামলাগুলো ফের সচল করা যাবে। ধড়পাকড়ও অব্যাহত থাকবে। এতে দলের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেবে। মামলা-গ্রেফতার ভয়ে মাঠে নামতে সাহস পাবে না নেতাকর্মীরা। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দুর্বল ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে। আর এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ।

এ ছাড়া খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন দমন করে আগামী নির্বাচনের সরকার নিয়ে কোনো আন্দোলন-ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না—বিএনপিকে এমন বার্তাও পৌঁছে দিতে চায় আওয়ামী লীগ। যাতে দলটি সহিংসতার পথ থেকে দূরে থাকে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়।

এ ছাড়া বিএনপির যেসব নেতাকর্মী বা শুভাকাক্সক্ষী এ সময় শক্ত ভূমিকা রাখবে তারও একটা তালিকা আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসবে। ফলে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপির ওই শক্তিকে দুর্বল করার যথেষ্ট সময় পাবে ক্ষমতাসীনেরা। তাই বিএনপির আন্দোলনে নামার পরিকল্পনার বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় সাজা হলে তিনি আপিল করতে পারবেন। কিন্তু তা না করে যদি বিএনপির নেতাকর্মীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীই জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় যা করার তাই করবে। তবে আমার ধারণা, বিএনপির নেতাকর্মীরা সেটা করবে না। কারণ দীর্ঘ আইনিপ্রক্রিয়া শেষে এ মামলার রায় হচ্ছে। খালেদা জিয়াও আইনিপ্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। তারা আদালতে লড়েছেন। আর এ মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা নয়। এ মামলা দায়ের করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যে সরকারের প্রধান ছিলেন বিএনপির নিয়োজিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিনের আমলে এ মামলা করা হয়েছে। এ জন্য তো আমরা দায়ী নই।

রায়কে ঘিরে দলীয় প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুুর রাজ্জাক বলেন, জনগণের জানমাল রক্ষায় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। আর দলের নেতাকর্মীরা সব সময় সোচ্চার আছে। যারা নাশকতা সৃষ্টি করবে, ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াও করবে, তাদের চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারণ আওয়ামী লীগ এ দেশের জনমানুষের দল। জনগণের জন্যই আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আওয়ামী লীগ,নির্বাচনী রাজনীতি,রাজনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist