কাইয়ুম আহমেদ

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফর শুরু আজ

লক্ষ্য দ্বন্দ্ব নিরসন ও তৃণমূল পুনর্গঠন

বারবার উদ্যোগ নিয়েও তৃণমূল পুনর্গঠনে ফলপ্রসূ হতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এর মূলে এমপি, মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতকেই দায়ী করছে দলটি। তবে এবার বেশ আঁটসাঁট বেঁধেই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন এই প্রাচীন দলটি। আজ শুক্রবার ১৫টি সাংগঠনিক টিম সারা দেশে সাংগঠনিক সফরে নামছে। জনপ্রিয় নেতারা যেন আড়ালে না থাকেন, সেদিকটা এবং তৃণমূল পুনর্গঠন করে নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্য নিয়েই এই সফর বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল নেতারা। এছাড়া যেসব জেলা-উপজেলায় প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব আছে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন এবং বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে। এদিকে, আগামী মঙ্গলবার সিলেট সফরে যাচ্ছেন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিনি এ সফরে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

বলা যায়, পুণ্যভূমি সিলেট থেকেই নির্বাচনী প্রচারণায় নামছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তার এই সফর ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করছে। পাশাপাশি দলকে সুসংগঠিত করতে এই সফর বেশ গুরুত্ব রাখবে। এ কারণে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রায় প্রতিদিনই বর্ধিত সভা ও কর্মিসভা করা হচ্ছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে গত শনিবার যৌথ কর্মিসভারও আয়োজন করা হয়েছে। অঙ্গ সংগঠনের উদ্যোগেও প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে নানা তৎপরতা চলছে।

সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ‘আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার আগমন দলকে সংগঠিত করবে ভূমিকা রাখবে। এছাড়া তিনি জনসভায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দেবেন। যা থেকে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে নির্বাচনের জন্য কাজে নেমে পড়বেন।’

এছাড়া এপ্রিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা সফর করবেন। নিকট অতীতে যাননি এমন জেলাগুলোয় যাবেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তরের পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় জনসভা করবেন। যাকে এক অর্থে নির্বাচনী সফরও বলা যেতে পারে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭৩টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। এই সফরে কোন্দলপূর্ণ জেলা-উপজেলা নেতাদের সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নেতারা মহানগর, জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশ, জনসভা, কর্মিসভা ও বর্ধিতসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।

প্রথম দিন আজ শুক্রবার মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচি এবং কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন। এ ছাড়া দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে বগুড়া, পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে নড়াইল ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে ফেনী জেলায় সাংগঠনিক সফরে বের হবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

দ্বিতীয় দিনে আগামীকাল শনিবার দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে নাটোর, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে পটুয়াখালী এবং সভাপতিমন্ডলীর সদস্য গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বান্দরবান জেলায় সাংগঠনিক সফর অনুষ্ঠিত হবে। বাকি জেলাগুলোর সাংগঠনিক সফরসূচি পরে ঘোষণা করা হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী এই সাংগঠনিক সফর সফল করার লক্ষ্যে সহযোগিতা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ২০১৮ সালে দল নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। প্রার্থী মনোনয়নের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ২০১৮ হবে নির্বাচনময়।

সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য লে.কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এই সফরে আমরা কর্মী সমাবেশের পাশাপাশি যেসব জেলা-উপজেলায় প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব আছে সেগুলো নিরসনের চেষ্টা করব। স্থানীয় নেতাদের সমস্যা থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা করব। স্থানীয় এমপি-উপজেলায় চেয়ারম্যান কিংবা মেয়রদের সমস্যা থাকলে সেগুলোও সমাধানের চেষ্টা করা হবে। তবে যদি কোনো কারণে এসব সমস্যা সফরে সমাধান করা না যায়, তাহলে কেন্দ্রে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।

সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ২০ বছরের একটা খতিয়ান তুলে ধরব; যেখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উন্নয়নের চিত্র থাকবে। সরকারের সফলতার চিত্রও তুলে ধরা হবে। জনগণই বিচার করবে এই সময়ে কোন সরকার তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। কার কাছ থেকে বেশি পেয়েছে।

মনোনয়ন প্রসঙ্গে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সফরে এলাকায় কে বেশি জনপ্রিয় কিংবা দলের জন্য সমস্যা—সেটা বেরিয়ে আসবে। পরে কেন্দ্রে আলোচনার মাধমে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে। এতে দলে ঐক্য সুসংহত হবে।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আসলে আমাদের এই সফরের লক্ষ্য হচ্ছে বিগত নয় বছরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড জনগণের সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নি-সন্ত্রাস ও ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরা হবে। গত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের জনগণের ওপর বিএনপির কোনো আস্থা নেই বলেই তারা সন্ত্রাস ও নাশকতার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে উন্নয়ন করেছে তাতে জনগণের ওপর আস্থা রয়েছে। এতে জনগণ উন্নয়ন ও শান্তির প্রতীক আওয়ামী লীগের পক্ষেই তাদের রায় দেবে।

সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বলেন, জনপ্রিয় নেতারা যেন আড়ালে না থাকেন, সেদিকটা এবং তৃণমূল পুনর্গঠন করে নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্য নিয়েই এই সফর। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। এতে জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হবে। জনগণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পক্ষে শান্তির পক্ষে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে।

সূত্র জানিয়েছে, ঢাকাসহ দেশের ৮ বিভাগের কমপক্ষে ৩২টি জেলা ও শতাধিক উপজেলায় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব চরমে। জয়পুরহাট, নাটোর, পটুয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সাতক্ষীরা, নীলফামারী, রংপুর, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, নড়াইল, চট্টগ্রাম অন্যতম। কমিটি গঠন ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটাতে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এমপি, সিটি মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এমনকি মেম্বাররাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন।

২০১৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের পর থেকে তৃণমূল গোছানোর কাজ শুরু করেন নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তখন থেকেই সম্মেলন, কর্মিসভা শুরু করেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে গোলযোগপূর্ণ ধরে ধরে তিনি সফর করেছেন অনেক জেলা। কোন্দলে জড়ানো নেতাদের নিয়ে একান্তে বৈঠকও করেন তিনি। কিন্তু অধিক কোন্দলপূর্ণ জেলাগুলোকে বাগে আনতে পারেননি কাদের। কোনো কোনো সম্মেলনে গিয়ে কোন্দলের কারণে ফিরেও আসতে হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে অনেক জেলা-উপজেলায় সম্মেলন হলেও হয়নি কোনো কমিটি।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহে ১৩ বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে কমিটিই ঘোষণা করতে পারেনি দলটি। সম্মেলন হলেও কমিটি হয়নি ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগেরও।

দুই বছর পার হলেও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবিরের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ কমিটি ঝুলে আছে। তারা কেন্দ্রে আলাদা আলাদা কমিটি জমা দেওয়ায় কমিটি চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান পদবঞ্চিত নেতারা।

সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন না হওয়ায় পদবিহীন নেতাকর্মীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটা সামাল দিতে কমিটি গঠনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের অবস্থা হ-য-ব-র-ল। এখানে ১৭ ইউনিয়নের প্রতিটিতে আছে দলটির একাধিক কমিটি।

এরইমধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে গত শনিবার ঢাকায় ডেকে জয়পুরহাট, নাটোর এবং পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠকে সবাইকে দ্বন্দ্ব নিরসন করে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলা হয়। এরআগে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নীলফামারী, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া জেলার নেতাদের ঢাকায় ঢেকে দ্বন্দ্ব নিরসনে কঠোর বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের এ সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু এরপরও এলাকায় তাদের সমঝোতার কোনো লক্ষণই ফুটে ওঠেনি। কারণ এলাকায় গিয়ে ফের দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপিরা। বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের সেচিত্র আবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের। তবে এই সফরে তৃণমূল পুনর্গঠনের মাধ্যমে দল আরো শক্তিশালী হবে এবং আগামী নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে—এমন প্রত্যাশা দলটির নীতিনির্ধারকদের।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দ্বন্দ্ব-সংঘাত,আওয়ামী লীগ,সাংগঠনিক সফর
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist