প্রতীক ইজাজ

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮

ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা

আশঙ্কাই সত্য হলো। শুরু থেকেই দেখা দেওয়া আইনি জটিলতার সমাধান না করায় আদালত তিন মাসের জন্য স্থগিত করলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন ও নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচন। এমনকি এ সময়ের মধ্যে এসব জটিলতার সমাধান না হলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে ভবিষ্যৎ নির্বাচনও।

ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে তফসিল হলে তা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নেয়নি। এমনকি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলও জটিলতা নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কেবল মুখে মুখে আশঙ্কার কথাই প্রকাশ করে আসছিল। এর ফলে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) দুই ধরনের জটিলতা দেখা দিল। একদিকে ভবিষ্যৎ মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল; অন্যদিকে মেয়রের অনুপস্থিতিতে নগরীর উন্নয়ন ও করপোরেশনের কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো। যদিও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, নির্বাচিত মেয়রের কাজটা চালানোর জন্য প্যানেল মেয়র দায়িত্ব পালন করবেন। তার অবর্তমানে দ্বিতীয় যিনি আছে তিনি করবেন। তার অবর্তমানে তৃতীয়জন করবেন। ভোট স্থগিত হলেও কোনো অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে না। কোনো ভ্যাকুয়াম থাকবে না। কিন্তু মন্ত্রীর এমন মন্তব্যে একমত হতে পারছেন না স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সিটি করপোরেশন কীভাবে চলবে, সেটি নির্ভর করবে সরকারের ওপর। যদি সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চালাবে। আর যদি প্যানেল মেয়র দিয়ে চালাতে চায়, সেটি হবে সংবিধান ও আইন পরিপন্থী।

এমনকি ‘মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ার প্রায় তিন মাস হয়ে গেল, সিটি করপোরেশন ভালোভাবেই চলছে, ওখানে প্যানেল মেয়র মহোদয় আছেন, উনি উনার কমিশনারদের নিয়ে ভালোই চালাচ্ছেন’ বলে মন্ত্রীর এমন দাবির সঙ্গেও একমত হতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মেয়রের মৃত্যুর পর উন্নয়নকাজের গতি শ্লথ হয়েছে। প্রয়াত মেয়র যেসব নাগরিকবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসব কাজেও ভাটা পড়েছে। দাফতরিক কাজে গতিহীনতার পাশাপাশি উন্নয়নকাজও চলছে ধীরে। নগর ভবনে বেড়েছে দলীয় ঠিকাদারদের পদচারণা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেবিলে টেবিলে ফাইলের স্তূপ, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা ইত্যাদি মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে গুলশান নগর ভবন। বিশেষ করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের যে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডটি অপসারণ করেছিলেন, তার অবর্তমানে রাস্তার ওপর আবারও পার্কিং শুরু করেছেন ট্রাকচালকরা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডিএনসিসি।

নির্বাচন স্থগিত হওয়ার জন্য বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুষছে। নির্বাচন ‘সরকারের ইঙ্গিতে’ স্থগিত হয়েছে বলে দলটি দাবি করেছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ভোটে হার ‘নিশ্চিত জেনেই’ সরকার এটা করেছে। কিন্তু বিএনপির এ অভিযোগের পাল্টা কোনো উত্তর না দিলেও সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারের সেতুমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সবকিছুতে সরকারের যোগসাজশ আবিষ্কার করেন কেন? এখানে সরকারের যোগসাজশের বিষয় নেই। আমরা এই নোংরা পলিটিকস করি না, এতে বিশ্বাসও করি না।’

একইভাবে নির্বাচনে কোনো বাধা ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সচিবের এমন মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল তফসিল ঘোষণার আগেই এ বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করা। শুধু ভোটার তালিকা, নতুন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মেয়াদ নয়, আরো অনেক জটিলতা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৮ নতুন ওয়ার্ডের ভোটাররা কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে পারলেও মেয়র পদে ভোট দিতে পারবেন না। ইসির ভালো আইনি পরামর্শক নেই কিংবা তারা কারো পরামর্শ কানে তোলেননি বলেই এত জটিলতা রেখে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন কমিশন ও মন্ত্রণালয় চাইলে আইনের মধ্য থেকেই এই সংকটের সমাধান করতে পারত এবং এখনো পারে।

গত ৩০ নভেম্বর মেয়র আনিসুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর ডিএনসিসির মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ৯ জানুয়ারি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির মেয়র পদসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি করে ৩৬টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং ৬টি করে ১২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডেরও ভোট হওয়ার কথা ছিল। এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৬টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন যথাসময়ে হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই এই নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। মূল সংশয় ছিল নতুন যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ডের ভোটারদের নিয়ে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ভোটার হতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন না—নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ যে কেউ আদেশ বাতিল বা সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের আগ পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত চেয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল বিএনপি ও দলের মেয়র প্রার্থী। সম্ভাব্য জটিলতা নিরসনে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তবে আইনি জটিলতা নেই বলে বলে আসছে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীনরা শঙ্কার কথা আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই জটিলতার কারণেই আটকে গেল নির্বাচন।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা নির্বাচন আটকে যাওয়ার পেছনে অবশ্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকেও কারণ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থাকায় এই নির্বাচন ঘিরে সরকারি দলে কিছুটা অস্বস্তি আছে। রংপুরে দলীয় মেয়র প্রার্থীর ভোটের বড় ব্যবধানে পরাজয়ের পর এখন রাজধানী ঢাকা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এমনকি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাও প্রকাশ পাবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের জন্য কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।

রিটকারী দুজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মূলত দুই কারণে নির্বাচন স্থগিত করেছেন আদালত। একটি হলো ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত ভোটার তালিকাই প্রকাশ করা হয়নি। এখন যিনি প্রার্থী হবেন, তিনি জানেন না তিনি ভোটার কি না। তাছাড়া মনোনয়নপত্রে ৩০০ ভোটারের স্বাক্ষর থাকতে হবে। ভোটার তালিকা প্রকাশ না হলে সেটা কীভাবে সম্ভব? আরেকটি কারণ হলো—স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৫ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, মেয়রের পদসহ করপোরেশনের পঁচাত্তর শতাংশ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হইলে, করপোরেশন, এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, যথাযথভাবে গঠিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে। কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টির ওয়ার্ড ধরলে কাউন্সিলরের সংখ্যা পঁচাত্তর শতাংশ হয় না। কারণ নতুন ১৮টিতে তো নির্বাচনই হয়নি। সে হিসাবে মেয়র পদ গঠন হয় না।

এ দুটি ছাড়াও আরো কিছু আইনি জটিলতার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, উপনির্বাচন নির্দিষ্ট মেয়াদেই করতে হবে। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর পদেও ভোট গ্রহণ করতে হবে। যদি এ দুটি পদের (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিতে ভোটগ্রহণ করা হয় অথবা নতুন ভোটারদের ভোট দেওয়া বা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া না হয়, সেক্ষেত্রে জটিলতার নিরসন হবে না। তা ছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মেয়াদকাল কত হবে, সেটা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্ধারণ করে দিতে পারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

নির্বাচন স্থগিতের তিন মাস প্যানেল মেয়র দিয়ে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে দু-এক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসে হাইকোর্ট নির্বাচন কী কারণে স্থগিত করেছেন এবং পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে কী করা যায়; সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। এমনকি সীমানা নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ আইনি জটিলতাগুলো সমাধানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার আশ্বাসও দেন মন্ত্রী।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, যে তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে, সে তিন মাস এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই প্যানেল মেয়র দিয়ে চলবে। সেক্ষেত্রে প্রথম প্যানেল না পাওয়া গেলে দ্বিতীয় প্যানেল মেয়র, দ্বিতীয় প্যানেল মেয়র না পাওয়া গেলে তৃতীয় প্যানেল মেয়র করপোরেশনের দায়িত্ব পাবেন। এর বাইরে স্থানীয় মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসতেও পারে। কারণ বিষয়টি স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের। তবে নির্বাচন হতে হবে—সেটাই মূল পথ।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্বাচন কমিশন,রাজনীতি,ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন,ডিএনসিসি নির্বাচন,আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist