প্রতীক ইজাজ

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে বিশ্লেষকদের মত

শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে সরকারকে

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আশা জেগেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারে নিরাপদে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। সর্বশেষ মিয়ানমারের অন্যতম মিত্রদেশ চীন ও রাশিয়ার মধ্যে চীনের মনোভাব কিছুটা বদলেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দেশটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার লি জুন। সেখানে সফররত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গত রোববার এক বৈঠকে জুন জানান, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারকে বার্তা দিয়েছে দেশটি।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখিয়েছে মিয়ানমার। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং টুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে প্রথম বৈঠকের প্রস্তাব দেন। পরদিন শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের পরামর্শ বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেল। সেখানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ করার সিদ্ধান্ত হয়।

মিয়ানমারের এই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে সু চির দফতরের ইউনিয়ন কাউন্সেলরকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অং সান সু চি তার কার্যালয়বিষয়ক মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সুইকে ঢাকায় পাঠাবেন। দুই দেশের সুবিধাজনক সময়ে মন্ত্রী সুইর বাংলাদেশ সফরসূচি চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র। এমন পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আরেক দফা বৈঠক এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন বৈঠকে আপত্তি নেই বাংলাদেশেরও। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ছয় দফা ও পাঁচ দফাকে ভিত্তি ধরেই প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করছে বাংলাদেশ। খুবই সতর্ক থেকে ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ তৈরি করা হচ্ছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও শরণার্থী গবেষকরা বলছেন, সবকিছু এখন আমাদের হাতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আগের চেয়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। স্পর্শকাতর বিষয়। তাই সর্বোচ্চ কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করতে হবে। কিছুতেই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে বসা ঠিক হবে না। এবারই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

এমনকি বিশ্লেষকরা এমনও মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পরিস্থিতি শান্ত করতে মিয়ানমার নামমাত্র কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পর অন্যবারের মতো এবারও প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে। তাই এবার চুক্তি মানতে বাধ্য করতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘকে রেখে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হতে পারে। যাতে কিছুতেই বিগত সময়ের মতো পিছিয়ে যেতে না পারে।

অবশ্য বিশ্লেষকরা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের মনোভাব বুঝে সরকারকে ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, তা হলে আলোচনায় সুবিধা হবে। এরআগে গত শুক্রবার অং সান সু চির সঙ্গে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশকিছু কৌশল নির্ধারণ করে দেশটি। বৈঠক শেষে মিয়ানমার সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার ওপর বিশেষ জোর দেন এবং এই লক্ষ্যে একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে যারা পালিয়ে গেছে, তাদের কোন কোন স্থান দিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, সেগুলো নির্ধারণ করা হবে। সেইসঙ্গে মুসলমান ছাড়াও অন্য জাতিগোষ্ঠী যেমন রাখাইন, দাইংনেট ও রামাগাইয়ের পাশাপাশি হিন্দু সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসন (রিহেবিলিটেশন) ও পুনর্নিষ্পত্তি (রিসেটলমেন্ট) কর্মসূচির ওপর জোর দেন সু চি।

সভায় আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, ২৫ আগস্ট ‘হামলাকারী সন্ত্রাসীদের’ একটি তালিকাও মিয়ানমার বাংলাদেশ সরকার, ইন্টারপোল ও জাতিসংঘের হাতে তুলে দেবে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও তারা সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ফের আমন্ত্রণ জানাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, স্টেট কাউন্সেলর তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন যে, বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সেগুলো অবশ্যই দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় বসার জন্য বাংলাদেশের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত—জানতে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে দেশের তিন কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও শরণার্থী গবেষকের কথা হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক খুবই জরুরি। তাদের সঙ্গে বসতে হবে। আলোচনা করতে হবে। সবকিছু এখন আমাদের হাতে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে বসা ঠিক হবে না। এবারই এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

এই সাবেক কূটনীতিক আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে সমাধানের পথ তৈরি করেছেন। আন্তর্জাতিক মহলকে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। এখন আমাদের মিয়ানমারকে সংকট সমাধানে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এই চাপ থাকতে থাকতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। বসার আগে স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাবনা ঠিক করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, শরণার্থী প্রত্যাবাসনের কিছু স্ট্যান্ডার্ড অবস্থান আছে। কিছু নিয়ম আছে। সেগুলো মানতে হবে। তবে চুক্তি কোনো বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এর আগে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না বলেই সমস্যার সমাধান হয়নি। এ নিয়ে তিনবার চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের পাশাপাশি জাতিসংঘকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমান রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়নি।

‘এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নাগরিকত্বের বিষয়ে; উল্লেখ করে এই কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বা শনাক্তকরণের বিষয়ে মিয়ানমারকে ছাড় দিতে হবে। দেশটি রোহিঙ্গাদের বহু বছর ধরে নাগরিকত্বহীন করে রেখেছে। সেই সুযোগ যেন গ্রহণ করতে না পারে, বাংলাদেশকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘকে রেখে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হতে পারে। তবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। বাংলাদেশের এমন শর্ত দেওয়া যাবে না, যাতে মিয়ানমার কোনো অজুহাত দেখাতে পারে।

‘এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। পুরো বিষয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক দক্ষতা দেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেই চুক্তি করতে হবে। যেন মিয়ানমার পেছাতে না পারে। মূল বিষয় হলো মিয়ানমার যেন এমন কোনো শর্ত দিতে না পারে, যাতে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে পরিস্থিতি ওদের অনুকূলে চলে যায়’ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও শরণার্থী গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, জাতিসংঘের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া পাঁচ দফায় সমস্যা সমাধানের পথ। সে দফা ধরেই আলোচনায় বসতে হবে। মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে দেশে ‘সেফ জোন’ তৈরি করতে হবে। এবার যেসব নতুন রোহিঙ্গা এসেছে, তাদের সবাইকে ফেরত নিতে হবে। এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা যৌথভাবে নিবন্ধন করছে। সুতরাং জাতিসংঘের তালিকা অনুযায়ী ফেরত নিতে হবে। কারণ এর আগে ১৯৯৩ সালে মিয়ানমার প্রথমে জাতিসংঘকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করতে রাজি ছিল না। পরে যদিও চুক্তি হয়েছে, কিন্তু সব রোহিঙ্গা ফেরত নেয়নি। তাই এবার ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও হতে হবে। কারণ জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার কাছে রোহিঙ্গাবিষয়ক বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণাদি আছে। ফিরিয়ে নেওয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য পুনর্বাসন ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই গবেষক আরো বলেন, বাংলাদেশকে এবার শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যদি শর্ত না মানে তা হলে কোনো চুক্তি করা ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকতে থাকতেই চুক্তি বাস্তবায়নও করতে হবে। নতুবা অন্যবারের মতো এবারও সময়ক্ষেপণ করে পরিস্থিতি শান্ত হলে পিছিয়ে যেতে পারে মিয়ানমার।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মিয়ানমার-বাংলাদেশ,রোহিঙ্গা,শরণার্থী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist