প্রতীক ইজাজ

  ২৪ মে, ২০১৭

দুর্ভোগ বাড়ছে

দুই মেয়রের ঘুম ভাঙবে কবে

চরম দুর্ভোগে দেশের মানুষ। একদিকে প্রাকৃতিক বৈরিতা, অন্যদিকে নাগরিক সেবার সংকট; ভয়াবহ বিপাকে ফেলেছে সবাইকে। দেশজুড়ে বইছে দাবদাহ। খড়ায় পুড়ছে মাঠ। রোগব্যাধি বাড়ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পানি সংকট। বিদ্যুৎ বিভ্রাট লেগেই রয়েছে। মশার উপদ্রব সীমাহীন। পানির অভাবে নষ্ট হতে বসেছে সবজির ফলন। প্রচণ্ড গরমে ঘরে বাইরে হাঁসফাঁস করছে মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণিকুল। কোথাও স্বস্তি নেই। সুশীতল আশ্রয় নেই। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে।

কোথাও কোথাও লু হাওয়া বইছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। গাছপালা কমে যাওয়ায় সামান্য একটু সুশীতল আশ্রয়ও নেই রাস্তার দুধারে। যাত্রী ছাউনিগুলোও দখলে। চলতে চলতে প্রচন্ড গরমে হঠাৎ করে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে মানুষ। মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। সেই সঙ্গে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আরো দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। গরমে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ধুলোবালি। যানজট, গাড়ির হর্ন, গণপরিবহন সংকট লেগেই রয়েছে। এমনকি কাজ শেষে ঘরে ফিরেও স্বস্তি নেই। বিদ্যুতের অভাবে সারারাত কাটছে নির্ঘুম। গরমে ঘেমে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে রোগে।

বিশেষ করে রাজধানীতে দুর্ভোগ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মশা নিধনের ওষুধ লার্ভিসাইড নেই। নগরীর ঘরে ঘরে এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। দাবদাহজনিত রোগব্যাধি প্রকট আকার নিয়েছে। সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। গরমে শিশু ও বৃদ্ধদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে।

প্রচন্ড দাবদাহে মানুষের এমন দুরবস্থার জন্য নগরবিদরা নগর কর্তৃপক্ষকেই দূষছেন। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে। সেই তাপমাত্রা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। দেশে সেসব উদ্যোগ অনুপস্থিত। বিশেষ করে রাজধানীতে কোনো নগরপিতা নেই বলেই তাদের ধারণা। তারা বলছেন, নগরপিতারা ব্যস্ত মূলত রাজনৈতিক কাজে। সাধারণ নাগরিকদের প্রতি তাদের কোনো মনোযোগ নেই। নাগরিক সুবিধার কথা তারা ভাবেন না।

এ ব্যাপারে নগরবিদ প্রকৌশলী মু. ইনামুল হক বলেন, আমাদের নগরপিতারা সরকারি দলের লোক। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত। দলের লোকজনকে সুবিধা দিতে ব্যস্ত। নাগরিকদের সেবায় তাদের মনোযোগ নেই। জবাবদিহিতাও নেই। সুতরাং, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকা আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।

একই সঙ্গে নগরবিদরা ‘নগরপিতাদের ঘুম ভাঙবে কবে’ বলেও অভিমত দেন। তারা বলেন, নাগরিক সেবা দিতে হলে জাগতে হবে। মানুষের দুর্ভোগ কষ্ট বুঝতে হবে। ঘুমিয়ে সেবা দেওয়া যায় না।

আবহাওয়া অধিদফতরও সুখবর দিতে পারছে না। সর্বশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে আবহাওয়া বিভাগ জানায়, লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ ভারতের বিহার ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। যা উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আগামী তিন দিনে আবহাওয়ার তেমন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নিচে থাকলে মাঝারি মাপের তাপপ্রবাহ বলে বর্ণনা করা হয়। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে এখন তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির দিকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাতাসের আর্দ্রতা, যা গরমের ভাবকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বছরটি অন্য বছরের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল বলে মনে করে আবহাওয়া অধিদফতর। কারণ এবার মার্চ-এপ্রিল মাসে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসে ২০০ শতাংশ বৃষ্টি বেশি হয়েছে। এখন তাপমাত্রা যা থাকার কথা তার চেয়ে ২-৩ ডিগ্রি বেশি আছে।

তা হলে এমন দাবদাহ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে করণীয় কি- জানতে চাইলে নগর ও পরিবেশবিদরা সেই একইভাবে সরকারের নগর দেখভালে দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই দায়িত্ব বর্তান। একইভাবে এমন পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করেন।

এ ব্যাপারে প্রকৌশলী মু. ইনামুল হক বলেন, নগরবিদদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। গাছ কেটে ফেলছে। সবুজ ধরে রাখার কোনো আগ্রহ নেই। অথচ এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে তাদের উচিত, রাস্তার দুপাশে সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা। এটি স্থায়ীভাবেই করা উচিত। রাস্তার দুপাশে চাপকল রাখতে হবে। সাধারণ মানুষ সেখান থেকে পানি পান করবে। বিভিন্ন পার্কে পর্যাপ্ত গাছ রাখতে হবে। এমনকি রাস্তার আইল্যান্ডে গাছ রাখতে হবে।

এই নগরবিদ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে বলেন, ইদানিং দেখছি রাস্তার আইল্যান্ডে আকাশনীলা নামে একটি বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। এ গাছের কোনো কাজ নেই। অথচ সেখানে নিম গাছ লাগাতে পারে। উত্তর সিটি করপোরেশনে দেখছি, বনসাই গাছ লাগানো হচ্ছে। অথচ সেখানে দেশি ফলজ বা বনৌষধি গাছ, বটগাছ লাগাতে পারে

এমন পরিস্থিতির জন্য নগরের দূষণকেও দায়ী করেন প্রকৌশলী মু. ইনামুল হক। তিনি বলেন, নগর দূষিত। অপরিকল্পিত। নাগরিকরাও এখন আর দুর্ভোগের প্রতিবাদ করেন না। কারণ সরকারের সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নগরপিতারা জনসেবা করেন না। সরকারের দফতরগুলো কাজ করছে না।

একইভাবে এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কিছু দায়িত্ব আছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান। তিনি বলেন, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপমাত্রা কমানো যাবে না। কিন্তু সেই তাপমাত্রা যেন মানুষের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। যেমন- এই গরমে মশার উপদ্রব কমাতে হবে। এ জন্য মশা নিধন কার্যক্রম নিতে হবে। ধুলোবালি কমাতে পানি ছিটাতে হবে। এখন বাতাসে যেন আগুনের হল্কা। রাস্তার পাশের গাছপালায় ও তেতিয়ে থাকা রাস্তায় প্রচুর পানি ছিটাতে হবে। তা হলে গরম কিছুটা কমবে। যাত্রী ছাউনি করে দিতে পারে। মানুষ গরম থেকে বাঁচতে সেখানে বিশ্রাম নেবে। বিশেষ করে পথচারীদের জন্য নগর জুড়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তার মোড়ে ও দুধারে অস্থায়ীভাবে সুপেয় পানি রাখতে হবে। সুপেয় পানির অভাবে মানুষ তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তায় খোলাভাবে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ধরনের শরবত পান করে আরো অসুস্থ হচ্ছে।

কিন্তু দেশের প্রধান শহরগুলোর পাশাপাশি রাজধানীর চিত্র ঠিক উল্টো। মশার অত্যাচারে মানুষ এখন অতিষ্ঠ। অথচ মশা নিধনের ওষুধ লার্ভিসাইডের অভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মীদেরও মশা নিধন কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা যায়নি। ফলে নগরীর ঘরে ঘরে এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১১ মে থেকে ১৭ মে পর্যন্ত এক সপ্তাহ ধরে তাদের কাছে মশার লার্ভা ও ডিম ধ্বংসের ওষুধ লার্ভিসাইড ছিল না। এ কারণে গত সপ্তাহজুড়ে কর্মীরা নগরীতে লার্ভিসাইড ছিটাতে পারেননি। ফলে মশার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।

রাজধানীজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। খোঁড়া হচ্ছে রাজধানীর ১৫০ কিলোমিটার পাকা সড়ক। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ সড়কের এক পাশ কাটা, অন্য পাশের প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা মাটির ঢিবি, বালুর স্তূপ, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যন্ত্রপাতি, বিশাল আকৃতির সব ক্যাবল ড্রাম। ঢাকা শহরকে নিয়ন্ত্রণ করে ১৯টি মন্ত্রণালয়ের ৫২টি সংস্থা। এভাবে অবাধে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রশ্ন উঠেছে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা নিয়ে। সিটি করপোরেশনের বিধান অনুসারে রাস্তা খোঁড়ার ২৮ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার বিধান থাকলেও তা দেখার কেউ নেই।

নগরবিদদের এমন পরামর্শ সঠিক বললেও সেসব ব্যবস্থা দেশে নেই বলে জানান ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম বলেন, তীব্র গরম থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতির ওপরই নির্ভর করতে হবে। কৃত্রিম উপায়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে যেসব জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সেসব এলাকায় বালু নিবারণ করতে গাছে ও রাস্তায় পানি ছিটানো হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল জানান, গরম কমাতে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে সে ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তবে অন্যান্য নাগরিক সুবিধা দিতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

অবশ্য দেশে এমন বৈরী আবহাওয়ার জন্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান পরিবেশ দূষণকেও দায়ী করেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী। কিন্তু ঢাকায় এমন অবস্থার জন্য দায়ী অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও যানবাহন। তা ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি) ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসি ব্যবহারের ফলে কক্ষের ভেতর ঠা-া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাইরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এটি কমাতে হবে। গাছপালা কমে যাচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীতে ২৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা, পার্ক, আদর্শ ছায়াযুক্ত স্থান থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকায় ৫ শতাংশও ছায়াশীতল স্থান নেই।

এই গরমে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, গরমে পর্যাপ্ত পানি পান করা, ঢিলাঢালা পোশাক পরিধান, দিনে একাধিকবার গোসল করা, ছাতা নিয়ে বাইরে বের হওয়া, হোটেলের খাবার খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। এ ছাড়া শাক-সবজি ও ফলমূল বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্ভোগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist