বিশেষ প্রতিনিধি

  ২৮ মার্চ, ২০১৭

ঢাকাকে দিল্লির আশ্বাস

তিস্তা চুক্তি হবে বাংলাদেশেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপ্রিলে ভারত সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না—এটি মোটামুটি নিশ্চিত। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে এবং শেখ হাসিনা সরকারের সময়ই তিস্তা চুক্তির আশ্বাস দিয়েছে দিল্লি। এমনকি সে চুক্তি হবে বাংলাদেশেই এবং তা হবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতেই। এ বছরের মে-তে অথবা আগামী বছর নরেন্দ্র মোদি ও মমতার বাংলাদেশে এ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এমন তথ্য জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ইতোমধ্যেই দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির খসড়া হয়ে গেছে। সে খসড়ার কিছু অংশ নিয়ে আগে থেকেই আপত্তি ছিল মমতার। সেখানে কিছু সংশোধনী এনে তা তিস্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাষ্ট্রে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। মমতা চাইছেন, চুক্তির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর কোনো আপত্তি না থাক।

সূত্র আরো জানায়, তিস্তা ইস্যুতে শেখ হাসিনার ভারত সফর পিছিয়ে পড়ার পর দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা বিষয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু ওই আলোচনা শেষ হয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোও তাদের চূড়ান্ত মতামত জানায়নি। ফলে এ সফরেই চুক্তিতে যেতে চাইছেন না মমতা। তবে দিল্লি এই বলে আশ্বাস দিয়েছে, সবকিছুই প্রস্তুত। কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এবার না হলেও এ বছর অথবা আগামী বছরের শুরুর দিকে এ চুক্তির ব্যাপারে তারা বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে। এমনকি ভারত এমনও আশ্বাস দিয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকতেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে। সূত্রগুলো আরো বলছে, ভারত এমন কথাও বলেছে, নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি রূপরেখা তৈরিকে তিস্তা চুক্তির অন্তরায় হিসেবে দেখলে চলবে না। দুই চুক্তির গুরুত্ব দুই রকম।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না কোন কোন চুক্তি হবে। তবে এটা বলা যায়, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে আপত্তি নেই। এর আগেও তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দিল্লি আশ্বাসও দিয়েছে।

যদিও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বহুল আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। তবে ভারত এই চুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক। এবার না হলেও পরবর্তী সময়ে এই চুক্তি সম্পাদিত হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, অভিন্ন নদীগুলোর বিষয়ে নিষ্পত্তি যেমন আমরা চাই, তেমনি ভারতও চায়। তা ছাড়া ২০১৫ সালের জুনে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে তিস্তা আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও এ নিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকে এ আলোচনা হবে। এটুকু বলতে পারি, এ সরকারই তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায় করবে এবং সেটি বাংলাদেশেই হবে।

চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী ভারত যাচ্ছেন ৭ এপ্রিল। পরদিন ৮ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক। ৯ এপ্রিল আজমির শরিফ যাবেন। ১০ এপ্রিল তিনি দেশে ফিরবেন। গত ১৪ মার্চ সোমবার ঢাকা ও দিল্লির উভয় দেশ একযোগে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সরকারি ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনায় মুখর দেশ। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুশীলসমাজ, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনও তিক্ষè নজর রাখছে এই সফরের ওপর। এ সফর নিয়ে বেশ সতর্ক সরকারও। সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকসহ ৪১টি চুক্তি সই হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন ও দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়টি।

পশ্চিমবঙ্গের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে কয়েকদিন ধরেই দেশটির গণমাধ্যমগুলোয় আলোচনা চলছে। মমতার সঙ্গে তিস্তার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আলোচনা চূড়ান্ত হয়নি বলে তিনি গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মমতা বলেছেন, বাংলাদেশকে তিনি ভালোবাসেন। তবে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তিনি করবেন না। তিস্তা নিয়ে তার আপত্তি নেই, তবে আলোচনা করে সমাধান করার কথা বলেন তিনি।

দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা কেবল তিস্তার পানি চুক্তি বা ৫৪ নদীর পানি বণ্টনের মধ্যে বেঁধে ফেললে ক্ষতি হবে। এটিকে এখন বৃহত্তর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই সফরে আঞ্চলিক প্রেক্ষিতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে যে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে; এখন বাংলাদেশকে সেটি গুরুত্ব দিতে হবে। এখন ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে আঞ্চলিক প্রেক্ষিত এসেছে। চীন এসেছে। ফলে কেবল তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিবেচনা করা যাবে না। তিস্তা বা পানি বণ্টন চুক্তি প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, ভারত যেন চীনের ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছু না বলে। কারণ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারত যে ভয় পাচ্ছে, সেটি ভিত্তিহীন। আমরা আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে সফল হবেন। কারণ এ সরকার বিভিন্ন সময় যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক করেছে, এবারও তা অব্যাহত রাখবে।

জানা গেছে, তিস্তার খসড়া বণ্টন চুক্তিতে আছে, তিস্তার পানির একটি অংশ স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রেখে বাকি অংশের ৫২ শতাংশ পাবে ভারত আর ৪৮ শতাংশ বাংলাদেশ। কিন্তু মমতার সরকার সেটা মানতে নারাজ। তারা বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশের বেশি পানি দিতে নারাজ। কারণ পশ্চিমবঙ্গের অন্তত পাঁচটি জেলা সেচের কাজে তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে মমতা ওইসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে তিস্তার পানি চুক্তি করতে নারাজ। এর আগে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসে শিগগিরই তিস্তার জট খোলার আশ্বাস দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রতি আস্থা রাখতে বলেছিলেন।

উল্লেখ্য, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সিকিম থেকে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করে। ছাতনাই থেকে নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় এক হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ ও ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ২৫ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো ভারত ১৯৮৫ সালে তিস্তার উৎসমুখে এবং তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা নামক স্থানে ব্যারাজ নির্মাণ করে। এর ফলে তিস্তা এখন শুধু নামেই আছে, পানি নেই বললেই চলে। ভরাট হয়ে গেছে ৬৫ কিলোমিটার নদী।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist