নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৮ মে, ২০২০

বাড়ছে ঝুঁকি

দেশে করোনায় আক্রান্ত শতাধিক সাংবাদিক

করোনায় আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা শতকের ঘর পেরিয়েছে। আর করোনায় মারা গেছেন তিনজন। করোনা মোকাবিলার অংশ হিসেবে সঠিক তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় প্রশ্ন উঠেছে গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত নিয়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারিতে গণমাধ্যমকর্মীদের ঘরে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও যতটা পারা যায় নিজেরা নিজেদের সুরক্ষিত রেখেই কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে গণমাধ্যমগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিউজ ও দায়িত্ব রেশনিং করার মাধ্যমে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এই উদ্যোগ নিতে হবে গণমাধ্যমের মালিকদের। একইসঙ্গে করোনায় আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষ ও সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছেন করোনা মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ১১৩ জন সংবাদকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ হাসাপাতালে, কেউ বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন সুস্থ হয়ে কাজেও যোগ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনজন গণমাধ্যমকর্মী করোনায় মারা গেছেন।

সংবাদকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা বলে আসছি। গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। প্রত্যেক সংবাদকর্মীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুরক্ষা সামগ্রী দিতে হবে। আমরা আইসোলেটেড বার্তা কক্ষ করার জন্য বলেছি। নিউজ ও দায়িত্ব রেশনিং করার আহ্বান জানিয়েছি। যাতে একটি ঘটনা কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কাভার করে তা সব গণমাধ্যম শেয়ার করতে পারে। তাতে ঝুঁকির মাত্রা অনেক কম থাকে।’

তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো কেউ যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম মালিকদের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। যারা মারা যাবেন তাদের জন্যক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কোনো কোনো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে না। এমনকি করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার পর তার পরীক্ষাও করানো হয়নি। এটি মালিকপক্ষের ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার জন্য একটি ভ্রান্ত কৌশল। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, ‘গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আমি মনে করি, করোনায় আক্রান্ত সাংবাদিকদের জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ঠিক করা উচিত। তা করতে না পারলে অন্তত প্রতিটি হাসপাতালে সাংবাদিকদের সুচিকিৎসার জন্য একটি নির্দিষ্ট কোটা মেইনটেইন করা উচিত। গণমাধ্যমকর্মীরা করোনা মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন। রাষ্ট্র কীভাবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে সে বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করছে। অতএব গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়ে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নিজ কর্মীদের করোনামুক্ত রাখতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা দেখেছি গুটিকয়েক গণমাধ্যম সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করেছে। আমাদের তিনজন গণমাধ্যমকর্মী মারা গেছেন। আমরা তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাই।’

জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর একাধিক গণমাধ্যম ‘হোম অফিস’ বা বাসায় বসে কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কয়েকটি পত্রিকার ছাপা বন্ধ করে শুধু অনলাইন ভার্সন চালু রাখা হয়েছিল। টেলিভিশনগুলোতে সীমিত মাত্রায় ‘ডিউটি রেশনিং’ বা সপ্তাহের অর্ধেক কাজ অর্ধেক ছুটির ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। তারপরও গণমাধ্যমকর্মীদের আক্রান্তের হার বেড়েই চলছে।

সর্বশেষ অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদনা সহকারী মাহামুদুন্নবী মজুমদার, দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার শেখ সাবিহা ও চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের অনুসন্ধানী রিপোর্টার আবদুল্লাহ আল ইমরান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর সপ্তাহখানেক আগে দৈনিক ভোরের কাগজের সাংবাদিক করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা লকডাউন শিথিলের নামে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করছি না। নাগরিক সচেতনতা যেটা সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেটা সৃষ্টি হয়নি। যে কারণে আমরা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীরা যেহেতু করোনা যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। কাজেই শতাধিক ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে আরো বড় একটি সংকটের জায়গা হলো অর্থনৈতিক সংকট। যা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এখানেও আমরা নিশ্চয়তা চাই। কারণ একটি স্বাবলম্বী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠত না হলে অবাধ নিরপেক্ষ মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। এ কারণে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের কাছে টাকা-পয়সা যেসব বকেয়া রয়েছে সব পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনের, সেগুলো অবিলম্বে পরিশোধ করা দরকার। বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সির কাছে যা পাওনা রয়েছে সেগুলো এখনই পরিশোধ করা উচিত। তা না হলে গণমাধ্যমের কর্মীদের বেতন-বোনাস অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যা আমাদের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই দুঃখজনক হবে।’

মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষার জন্য নিজের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এখন এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে সরকার বা অফিস কে কী করে দিল সেটার দিকে যদি কেউ তাকিয়ে থাকে তাহলে তাকে সাফার করতে হবে। কারণ সরকারও সেভাবে করতে পারছে না বা পারবে না। আবার হাউসগুলোও নানা ইস্যু আছে। বেতন-ভাতা পরিশোধ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই বেতন-ভাতা দিতে পারছে না। যেখানে ঠিক মতো বেতন-ভাতাই দিতে পারে না অফিসগুলো, সেখানে কর্মীদের জন্য কী ব্যবস্থা নেবে বা দেবে? আমি মনে করি নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনায় আক্রান্ত,সাংবাদিক,করোনা ঝুঁকি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close