নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ মে, ২০২০

বাঙালির অনন্য বাতিঘর

বাঙালি জাতির জীবনে যে কয়েকজন নিরাবেগ ব্যক্তিত্ব দল-মত নির্বিশেষে ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও মানুষের যেকোনো বিপর্যয়ে যুক্তিযুক্ত দিকনির্দেশনা দিয়ে ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি অতন্দ্র বাতিঘরের মতো গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় জাতিকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে নিভে গেল জাতির সেই বাতিঘর। দেশের প্রতিটি সংকটকালে তার বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। পুরো বাংলাদেশের স্পিরিটটা, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংবিধানে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের তাৎপর্য, উৎপত্তি বোঝার মতো যে ক্ষমতা থাকা দরকার সেটার অভাব মেটাতে পেরেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন কিন্তু সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য তার ভূমিকা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আনিসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই, শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ব বহন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনার ক্ষেত্রে চেতনার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। একজন শিক্ষক, একজন সমাজমনস্ক মানুষ, প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী একজন অনন্য সাধারণ মানুষ হিসেবে তাকে আমরা সব সময় বিবেচনা করি।

১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে একটি খবর ছাপা হয় রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের জাতীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস করতে বলা হয়। এর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিবৃতিতে আনিসুজ্জামান স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন এবং সেটা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দেন। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সেই সময় থেকেই আনিসুজ্জামান তার ভূমিকার জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালির সংস্কৃতির আন্দোলনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ান।

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। বাংলাদেশে চলে আসার পর খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল (বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাবি থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাবিতে বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতির অভিধানসহ যেকোনো প্রকল্পে তার অবদান ছিল সীমাহীন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান।

১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি ছিল সেটার নেতৃত্বে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। এছাড়া ১৯৯১ সালে গঠিত গণ আদালতের একজন অভিযোগকারী ছিলেন তিনি। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না।

শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী’ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হিসেবেও ড. আনিসুজ্জামান দায়িত্ব পালন করেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় অধ্যাপক,অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান,বাঙালি জাতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close