নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

চুড়িহাট্টার ১ বছর

স্মৃতি ছুঁয়ে কাঁদে ‘কষ্টেরা’

বৃষ্টি আর দোলা—নামের মতো দুজনের সম্পর্কটাও যেন ছিল আত্মার। মৃত্যুতেও আলগা হয়নি সেই বন্ধন। প্রকৃতির অদ্ভুত অথচ নির্মম খেয়ালে একই দিনে একসঙ্গে হারিয়ে যেতে হয়েছে দুজনকে। আজিমপুর কবরস্থানের একই মাটিতেই হয়েছে শেষ শয্যা। এক বছর আগে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ভয়াবহ আগুন দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তারান্নুম দোলাকে কেড়ে নিয়ে মুছে দিয়েছে দুই পরিবারের আনন্দ। স্বজনরা দুজনের স্মৃতিমাখা জিনিসগুলো হাতড়ে তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু বারবারই সেসব হয়ে ওঠে কষ্টের কারণ। বৃষ্টি-দোলা ছাড়াও রানা-মাসুদ, আনোয়ারের মতো সেদিন হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনরা কেমন আছেন, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে মেলে বুকচাপা কষ্টের কথা।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের চাইল্ড কেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টির বাড়ি হাজি রহিম বক্স লেনে আর ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইনি পড়ুয়া দোলার বাসা শেখ সাহেববাজার রোডে। চুড়িহাট্টার কাছেই দুজনের বাড়ি।

বৃষ্টি ও দোলা বেঁচে থাকতে যে সম্পর্ক ছিল, দুই পরিবারের মধ্যে এখনো তা আছে বলে জানান বৃষ্টির মা শামসুন্নাহার। দুই পরিবার তো একই ধরনের ভুক্তভোগী। আর এই বেদনা কি ভোলা যায়? যত দিন বেঁচে থাকব, বয়ে বেড়াতে হবে এই বেদনা।

বৃষ্টির বাবা জসিমউদ্দিন মেয়ে হারানোর কষ্টকে চাপা দিয়ে বলেন, বেদনা বাড়বে, তাই মনে করতে চাই না। যখন মেয়ে নিখোঁজ ছিল তখন মনে নানা প্রশ্ন ছিল, মেয়েকে কোনো চক্র ধরে নিয়ে গেছে কি না। যখন ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম যে আমাদের মেয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার, তখনই কষ্ট চলে গেছে। তাদের কবর দিয়ে দিয়েছি। এখন আর মনে করতেও চাই না সেই স্মৃতি। কিন্তু দোলার মা সুফিয়া রহমান ছোট মেয়ে মালিয়া মেহবীন নুসাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেও হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। সময় আর ফুরাচ্ছে না, যতই দিন যাচ্ছে, কষ্টও বয়ে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহন করতে হবে। দোলার বাবা এখন আর দলিল লেখার কাজ করেন না। মেয়েকে হারিয়ে উদাসীন হয়ে গেছেন। সারা দিন বাসায় কম্পিউটারে মেয়ের পুরোনো স্মৃতি দেখেন আর বাসার ছাদে উঠে গাছে পানি দেন। কোথাও তেমন একটা বের হন না।

সেই রাতে আগুনে পুড়ে যান দুই ভাই মাসুদ রানা (৩৮) ও মাহবুবুর রহমান রাজু (৩৪)। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত যে ভবন থেকে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় ‘এমআর টেলিকম সেন্টার’ নামে দোকান চালাতেন তারা। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর ঘোষকামতা গ্রামে তাদের বাড়ি।

রানার বাবা সাহেব উল্লাহ বলেন, অনেক কষ্ট করে তাদের এত বড় করেছি আর এভাবে চলে গেল। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। রাজুর ছোট ছেলে আর তার স্ত্রীরইবা ভবিষ্যৎ কী?

রানার চাচা এম এ রহিম জানান, তারও একটি দোকান ছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায়। সেই রাতে ঘটনার আট মিনিট আগে বাসায় (বালু রোড) কোনো এক দরকারে চলে যান। রানা ও রাজুর বাবা-মাও সেই রাতে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। কিন্তু এক মিনিট আগে দোকান থেকে বাসায় চলে যাওয়ায় বেঁচে যান তারা।

সেরাতে মৃত্যুর মিছিলে নাম লেখানো আরেক পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের মজিবুর রহমান হাওলাদার (৪৮)। চুড়িহাট্টা এলাকায় ভাড়ায় ভ্যানগাড়িতে করে মালামাল পরিবহন করতেন তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন হাওলাদারের পরিবার। চুড়িহাট্টার আগুনে মারা যান রাজবাড়ীর রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৫৫)।

আনোয়ারের মৃত্যুর পর ইসলামবাগের বাসা ছেড়ে ছোট ছোট তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে ঠাঁই নিয়েছেন স্ত্রী হাজেরা বেগম। স্বামীকে হারানোর পর একটি খেলনার কারখানায় কাজ নিয়েছেন হাজেরা। বেতন পান পাঁচ হাজার টাকা। তা থেকে দুই হাজার টাকা বাসাভাড়া দিয়ে মাত্র তিন হাজার টাকায় চলতে হয় পুরো মাস। চরম অর্থকষ্টে হাঁপিয়ে উঠেছেন হাজেরা। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা শাহি মসজিদের সামনে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট সাড়ে চার ঘণ্টার মতো কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। ভয়াবহ ওই আগুনে এই দুজনসহ পুড়ে মারা যান ৭১ জন; যাদের মধ্যে ২৭ জনই ছিলেন শ্রমিক।

এদিকে, নিহতদের মধ্যে ময়নাতদন্ত ছাড়াই চারজনের লাশ নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। বাকি ৬৭ জনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর বাকি ২২ জনের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে স্বজনদের দেওয়া ডিএনএর নমুনা থেকে আরো ১৯ জনের মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে এখনো তিনজনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

গতকাল বুধবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ড. সোহেল মাহমুদ বলেন, এখনো তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখন যদি কেউ দাবিদার থাকেন, তাহলে ডিএনএ ও মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চুড়িহাট্টা,ওয়াহেদ ম্যানশন,অগ্নিকাণ্ড
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close