নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

আত্মসমর্পণের আগে পাক সেনাদের সেই মুহূর্তগুলো

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর লড়াইয়ে ভারতীয় সেনারাও প্রাণ হারায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সময় আনুমানিক সকাল ৯টা। ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা তাদের দফতরে একসঙ্গে বসে বৈঠক করছিলেন। সে সময় একটি চিরকুট এসে সবাইকে চমকে দিল।

বৈঠকে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি, মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী, সিদ্দিক সালিক এবং আরো কয়েকজন। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’ এখানে ‘আবদুল্লাহ’ বলতে জেনারেল নিয়াজিকে বোঝানো হয়েছিল। নিয়াজির পুরো নাম আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, যিনি এ কে নিয়াজি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা।

সকাল ৮টা নাগাদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে মেজর জেনারেল নাগরাকে বহনকারী একটি সামরিক জিপ এসে থামে। জেনারেল নাগরা কীভাবে ঢাকার প্রবেশমুখে এসে পৌঁছলেন সেটি সবাইকে অবাক করেছিল। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ভেবেছিলেন যুদ্ধবিরতির জন্য বার্তা পাঠিয়েছেন মেজর জেনারেল নাগরা।

তিনি জেনারেল নিয়াজিকে প্রশ্ন করেন, তিনি (জেনারেল নাগরা) কি আলোচনার জন্য এসেছেন? কিন্তু নিয়াজি সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। কারণ এর আগে পাকিস্তানের তরফ থেকে ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তখন সেনানিবাসে এসব ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। তার লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে তখনকার ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া সেই সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে বই লিখেছেন রাও ফরমান আলী খান।

তার লেখা বই ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ বইতেও বিষয়গুলো উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তিনি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বেসামরিক প্রশাসন দেখাশুনা করতেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল রাও ফরমান আলী খানকে দায়ী করা হয়। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের উপদেষ্টা।

রাও ফরমান আলী খান তার বইতে লিখেছেন, ‘আমি নিয়াজিকে প্রশ্ন করলাম, আপনার প্রতিরক্ষা শক্তি কতটুকু আছে? কিন্তু নিয়াজি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন।’ এ প্রসঙ্গে অ্যাডমিরাল শরিফ পাঞ্জাবি ভাষায় জেনারেল নিয়াজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কি কিছু রয়েছে?’ এরপর নিয়াজি মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন। জেনারেল জামশেদের দায়িত্ব ছিল ঢাকা রক্ষা করা। জেনারেল নিয়াজি যখন মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন তখন তিনি মাথা ঘুরিয়ে ‘না’ সূচক জবাব দিলেন।

‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘তখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ একসঙ্গে বললেন, ‘সেটাই যদি হয় তাহলে সে (জেনারেল নাগরা) যা বলছে সেটাই করুন।’ এরপর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠানো হলো।

একই সঙ্গে মিরপুর ব্রিজের কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের বলা হলো তারা যেন যুদ্ধবিরতি মেনে চলে এবং জেনারেল নাগরাকে নিরাপদে শহরে ঢুকতে দেয়। সে মুহূর্তটিকে সিদ্দিক সালিক বর্ণনা করেছে এভাবে, ‘ভারতীয় জেনারেল হাতে গোনা সেনা এবং অনেক গর্ব নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। তখনই কার্যত ঢাকার পতন হয়ে গেল।’

রাও ফরমান আলী খান তার বইতে লিখেছেন, ‘আমরা বললাম, আপনার এতে যোগ দেওয়া উচিত হবে না, আত্মসমর্পণ করা হয়ে গেছে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে, যেটি বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এরপর জেনারেল নিয়াজি তার রিভলবারটি জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তিযুদ্ধ,পাক সেনা,আত্মসমর্পণ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close