জুবায়ের চৌধুরী

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

এক বাড়ির জন্য ৪৬ মামলা!

রাজধানীর শান্তিবাগের ১০৭ নম্বরের পৈত্রিক বাড়িতে একরামুল আহসান কাঞ্চন সপরিবারে থাকতেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের সংসার। হঠাৎ করে একটি সাজানো মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। জামিন নিয়ে বের হওয়ার সময় ঘাড়ের ওপর ভর করে নতুন আরেকটি মামলা। একটি, দুটি কিংবা ১০টি নয়, ৪৬টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

যে দুধের শিশুটিকে বুকে নিয়ে মামলার জালে জড়িয়েছে হতভাগ্য বাবা, সেই শিশুটি এখন কৈশোরে পা দিলেও মামলার জটাজাল থেকে মুক্তি পায়নি হতভাগ্য বাবা কাঞ্চন। তার যে একজন বাবা আছে, সেটিও বিশ্বাস করতে চায় না নিজের সন্তান এনামুল আহসান। যখন থেকে এই শিশুটি বুঝতে শিখেছে, বাবা ডাকতে পেরেছে, তখন থেকেই তো বাবা কাঞ্চন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এ কারণে বাবা-ছেলের আত্মিক মেলবন্ধন গড়ে উঠেনি। এই বাবা-ছেলের সম্পর্কে দূরত্ব রয়ে গেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তার বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে। যেখানে মামলার শুনানি, সেখানকার কারগার তার আবাসস্থল। এমন কথা বলেন, কারাগারে বন্দি থাকা কাঞ্চনের স্ত্রী তামান্না আকরাম।

তিনি বলেন, আমার স্বামী কাঞ্চনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৬টি সাজানো মামলা হয়েছে। এমন কোনো অভিযোগ নেই যা তার ওপর প্রয়োগ করা হয়নি। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মানব পাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধের সাজানো মামলার আসামি বানানো হয়েছে তাকে। একটি মামালায় জামিন নিলে আরেকটি মামলা হাজির হয় তার বিরুদ্ধে। ১৮ বছরের বিবাহিত জীবনের মাত্র আট বছর স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে পেরেছেন তিনি। বাকি ১০ বছর কারাগারেই কেটেছে স্বামী কাঞ্চনের। গত ১৫ বছরে একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ৪৬টি মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনি ২৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন।

নথি ঘেঁটে জানা যায়, ২০১০ সালে গরুর চামড়া ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মতিঝিলের মুহম্মদ শাকেরুল কবির নামে এক ব্যক্তি মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একরামুল হক কাঞ্চন এবং বাবু ওরফে গোইয়াল্লা বাবুকে আসামি করে পিটিশন মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, একটি গরুর চামড়া যার মূল্য আনুমানিক ২ হাজার ৫০০ টাকা, ছিনিয়ে নিতে কাঞ্চন ও বাবু বাদীর ওপর ছুরি হামলা চালিয়েছিল। ২০১৫ সালে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চকোরিয়ার আশা বেগম মানব পাচারের মামলা করেন আকরামুল আহসান কাঞ্চন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলম মিয়ার বিরুদ্ধে।

ঘটনার স্থান দেখানো হয় কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার মনু ড্রাইভারের ডাক বাংলো। মামলায় বলা হয়, বাদীকে হংকং পাঠানোর কথা বলে ১ লাখ টাকা নেয় কাঞ্চন। পাঠানোর কথা বলে, চকোরিয়ার ডাক বাংলোতে আটকে রেখে তাকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো হয়।

কাঞ্চনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজল বলেন, একটি চক্র কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাজানো মামলা করে। আমি নিজে ১০ থেকে ১২টি মামলায় তাকে জামিন করিয়েছি। উদাহরণ টেনে বলেন, কোনো একটি মামলায় কাঞ্চন ঢাকা কোর্টে হাজিরা দিতে আসে। অথচ ওই একই দিন একই সময়ে যশোরেও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। কাঞ্চন যে সাজানো মামলার ঘটনার দিন ঢাকায় আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন তা আমরা যশোর আদালতে উপস্থাপন করি। ওই কাগজপত্র উপস্থাপন করা হলে তাকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

কাঞ্চনের স্ত্রী তামান্না আকরাম বলেন, তার শাশুড়ি কমেরুন নাহার, ভাসুর আক্তার-ই-কামাল, ননদ ফাতেমা বেগম ও তাদের মামাতো ভাই শাকেরুল কবির রাজাবাগ পীর সাহেবের মুরিদ। ১৯৯৫ সালে তার শ্বশুর ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার শাশুড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি জমি রাজারবাগ পীরের নামে দান করেন। এ ছাড়া তার শাশুড়ি পীর সাহেবের মেয়ের বিয়েতে ৪০ ভরির স্বর্ণালঙ্কার উপহার দেন।

তিনি আরো জানান, ২০০৪ সালের দিকে তার শাশুড়ি ও ভাসুর শান্তিবাগের বাড়িটি পীর সাহেবের নামে দান করতে চান। তখন তার স্বামী ও তাদের ছোট ভাই কামরুল আহসান তাতে বাধা দেন। এ নিয়ে তার শাশুড়ি ও ভাসুর পীর সাহেবের কাছে অভিযোগ দেন। এরপর থেকে পীর সাহেব ও তার চার ভাই এবং তাদের মুরিদদের দিয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে একের পর এক মামলা দায়ের করতে থাকেন। দেবরের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে দেবর এখনো আত্মগোপনে আছেন। স্বামী জেলে যাওয়ার পর তিনি শান্তিনগরের শ্বশুরের বাড়ির থেকে বের হয়ে শেওড়াপাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকছেন।

উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত আট জঙ্গি সংগঠন হলো আল্লাহর দল, উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত, ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, তামিরউদ্দীন বাংলাদেশ, তৌহিদি ট্রাস্ট, হিজবুত তাওহিদ, শাহাদত-ই-নবুয়ত ও জামাত-আস-সাদাত। গত ৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল্লাহর দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সংগঠনটি রাজারবাগ পীর সাহেব পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর একদল সশস্ত্র ব্যক্তি মতিঝিলে বলাকা ভাস্কর্যটি ভাংচুর করে। এ ঘটনায় পুলিশ উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের আটজন সশস্ত্র কর্মীকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানান, তারা রাজারবাগ বড় পীর হুজুর সৈয়দ দিল্লুর রহমানের অনুসারী। উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সংগঠনটি সেখান থেকে পরিচালিত হয়। হুজুর সৈয়দ দিল্লুর রহমানের নির্দেশে তারা বলাকার মূর্তির ভাংচুর করেছে। এ ঘটনার কয়েক মাস পর উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের সশস্ত্র অনুসারীরা বিমানবন্দর গোলচক্করে বাউলের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলে উচ্ছেদ করে। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট চত্বরে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটি স্থাপনের কয়েক দিনের মধ্যে উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সেটি সরিয়ে ফেলতে উড়ো চিঠিতে হুমকি দেয়। পরবর্তী সময়ে ওই বছরের ২৬ মে গভীর রাতে উচ্চআদালত কর্তৃপক্ষ লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলে। এসব জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংগঠনটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মামলা,বিভিন্ন মামলা,বাড়ি দখল,শান্তিবাগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close