কাইয়ুম আহমেদ

  ২৫ মার্চ, ২০১৯

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে একধাপ

প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রতি সায় দিয়েছে জাতিসংঘ

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ আরো এক ধাপ এগিয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হবে। এখন এই ধাপ অতিক্রম করতে কাজ করছে বাংলাদেশ।

তাছাড়া দিবসটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে কীভাবে স্বীকৃতি পাওয়ানো যায় সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কথা বলার ব্যাপারে জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে সরকার। শিগগিরই এটি বাস্তবায়নের আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সেই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং প্রিভেনশন অব জেনোসাইড বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডামা ডিয়েং গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, যদিও কয়েকটি দেশ এর বিরোধিতা করবে তবু আমরা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করব। এখন অ্যাডামা ডিয়েংয়ের এই আশ্বাস আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না কি সত্যিই আলোর মুখ দেখবে। এই আশাজাগানিয়া প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়েই আজ সোমবার তৃতীয়বারের মতো জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস।

এর আগে বেসরকারি উদ্যোগে ২০০১ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথমবার তোলা হলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা এগোয়নি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো ৯ ডিসেম্বরে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা নেই। আমাদের মুখ্য সুযোগ ছিল ২০১৫ সালে। তখন জাতিসংঘের ভুল সংশোধনের জন্য কূটনীতিকরা সেভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া খুুব সহজ হবে না। একাত্তরে পাকিস্তানকে সহযোগিতা, সমর্থন জানিয়ে আসা আমেরিকা, চীন ও ইসলামিক উম্মাহর দেশগুলোর অমানবিক চেহারা যে তাহলে প্রকাশ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার ২৫ মার্চের গণহত্যা বিষয়ে বিশ্বে জনমত গঠনে কাজ করছে।

আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এদেশে যারা স্বাধীনতা প্রিয় এবং স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করেন তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা যে পৈশাচিক, অমানবিক হত্যাকা- চালিয়েছিল, সেই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কাজটি করেছেন। শুধু তাই নয়, দিবসটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে কীভাবে স্বীকৃতি পাওয়ানো যায়, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কথা বলার ব্যাপারে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। আশা করি, অতি দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

জানা যায়, গত কয়েক দশকে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ফোরামে দাবি জানিয়ে আসছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০০৭ সালে প্রথম ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি চেয়ে জাতিসংঘে চিঠি দেয়। পরে ওই চিঠির ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের মার্চে জাতিসংঘ থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বছরব্যাপী গণহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে।

১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা রয়েছে।

প্রথমত, কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা; দ্বিতীয়ত, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন; তৃতীয়ত, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন; চতুর্থত, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং পঞ্চমত, শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী উনিশ শতক থেকে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে রয়েছে আর্মেনীয় গণহত্যা, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা এবং সর্বশেষ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা জঘন্যতম। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এক রাতেই প্রায় ৫০ হাজার বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গণহত্যা,কালরাত,ভয়াল ২৫ মার্চ,আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close