হাসান ইমন

  ০৫ মার্চ, ২০১৯

নেপথ্যে ৩ কারণ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মেয়রের নানামুখী উদ্যোগের পরও দখলমুক্ত করা যায়নি রাজধানীর ফুটপাতগুলো। উল্টো দিনের পর দিন অবৈধ দখলদারের কব্জায় যাচ্ছে এসব ফুটপাত। প্রতিদিনই বাড়ছে ফুটপাতে হকারের সংখ্যা। এসবের নেপথ্যে রয়েছে তিন শ্রেণির মানুষ। তারা হলেন—স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী, অসাধু পুলিশ চক্র ও দুই সিটির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কারণে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ স্থায়ী হয় না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের একান্ত সদিচ্ছাই পারে রাজধানীকে হকারমুক্ত করতে।

নগরবাসীর নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের সুবিধার্থে নির্বাচিত হলে ঢাকার ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুই মেয়র। এরই মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় ৩ বছর পার করছেন তারা। এখন তারা বলছেন, হকারদের আয়ের ওপর পরিবারের সদস্যরা নির্ভরশীল বলে উচ্ছেদে মানবিক বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। মেয়রদের কেউ বলছেন, দায়িত্ব নেয়ার পর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হকার উচ্ছেদ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ফোর্স চলে আসার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই তা পুনর্দখল হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারের উচ্চ মহলেরও সহযোগিতা কামনা করছেন তারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরার হাউস বিল্ডিং ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় মূল রাস্তার মাঝখানে দেখা গেল হকারদের ভ্যানের দীর্ঘ সারি। হকাররা ভ্যানে করেই বিক্রি করছেন নানা পসরা। উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর ছাড়াও এ অবস্থা বিরাজ করছে আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডিতে। আর পুরোনো এলাকা মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড়, রাজধানী সুপার মার্কেট, ডিআইটি মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি হয়ে ফকিরাপুল মোড়। ফকিরাপুল মোড় থেকে নয়াপল্টন হয়ে কাকরাইল মোড়। পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট, জিপিও, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত, পল্টন মোড় থেকে তোপখানা রোড হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বিজয়নগর পর্যন্ত সড়কগুলোর দুই পাশে সারি সারি করে বসানো হয়েছে বিভিন্ন দোকানপাট। এছাড়াও রাজধানীর নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আজিমপুর, লালবাগ, সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার, বাবুবাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও রেলগেট, কমলাপুর, মুগদা, বাসাবো, মাদারটেক, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, কাজীপাড়া, গাবতলী, শ্যামলী, আদাবরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাত দখল করে বসানো হয়েছে অসংখ্য দোকানপাট।

এসব স্থানে ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে রেখেছে হকাররা। ফুটপাথের দোকান থেকে অল্প দামে জিনিসপত্র কিনতে পারলেও চলাচলে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। এ কারণে ব্যাপক ক্ষুব্ধ নগরবাসী। বিভিন্ন সময় তারা ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবির কারণে সিটি করপোরেশন থেকে বারবার হকার উচ্ছেদে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও প্রতিবারই সকালে উচ্ছেদ করলে বিকেলে দোকানপাট নিয়ে বসে যায় হকাররা। অনেক সময় সকাল-বিকেল দুইবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার পরে দোকান নিয়ে বসে পড়ে তারা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, হকাররা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। নেতারা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে মিছিলে হকারদের নিয়ে যান। এছাড়া সরকারি রাস্তা ও ফুটপাতে ব্যবসা করলেও এসব হকারের কাছ থেকে সরকারি দলের নেতারা চাঁদাবাজি করেন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লাইনম্যানদের মাধ্যমে চলে যায় তাদের কাছে। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার অংশ সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন দফতরেও যায় বলে প্রচার আছে। ফলে মেয়রসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও হকার মুক্ত হচ্ছে না ফুটপাত-রাস্তাঘাট। বিকেল ৪টার আগে ফুটপাতে হকার না বসার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সেই নির্দেশ লঙ্ঘন হয়েছে বহু আগে। সুযোগ পেলেই হকার বসছে ফুটপাত এবং কোথাও কোথাও ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তায়। ফুটপাত ধরে মানুষের হাঁটা দূরে থাক, কোনো কোনো এলাকায় ফুটপাতে মানুষ ঢুুকতেই পারছে না। লাইনম্যান, স্থানীয় মাস্তান, প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা ও কিছু পুলিশ সদস্য এসব হকার বসিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ফুটপাত হকার মুক্ত করতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতি বন্ধ করতে হবে। কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক লোক প্রভাব খাটিয়ে হকার বসিয়ে তাদের থেকে টাকা উঠান। এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তাহলে ফুটপাত হকারমুক্ত হবে।

এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘শুধু নগর ভবনের আশপাশের এলাকায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হকার ছিল। যাদের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে সড়ক ব্যবহার করত। আমরা পথচারীদের চলাফেরা নির্বিঘ্নে করতে হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। অবৈধ দখলদারদের কোনো প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘রমজানে মানবিক কারণে ফুটপাতে বসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফুটপাত ছাড়ছিল না। এখন তাদের উচ্ছেদের মাধ্যমে রাস্তা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে চাই।’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান মতে, নগরীর ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাতই এখন অবৈধ দখলে। আর ২২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রয়েছে বেদখল। এগুলোতে সরকার দলের অঙ্গ সংগঠনে নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় বসেছে পণ্যের পসরা। কোথাও কোথাও ফুটপাথ ছাড়িয়ে মূল সড়ক পর্যন্ত বসছে তারা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফুটপাথ,হকার উচ্ছেদ,রাজধানী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close