বিশেষ প্রতিনিধি

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

ফিরে আসে বিজয়

একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নতুন মাত্রা পায়। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হয় বাঙালির সম্মুখযুদ্ধ। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সার্থক হামলায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো কোণঠাসা করে তোলে।

আজ ৩ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত কমান্ড। অধিনায়ক হন ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। সে রাতেই যশোর, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর জেলার আরো কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

সিলেটের ভানুগাছায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। রংপুরের পলাশবাড়ীতে ১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে যায় পাকিস্তান বাহিনী।

পাকিস্তান এয়ারলাইনস পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। হঠাৎ করেই ভারতের বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান। বিকেল ৫টায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে, ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।’ ৫টা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে পাঠানো হয় ভারত ভূখন্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে।

এদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এত দিন ধরে ‘বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’ ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। এই দিন দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু তার আগেই বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও গণহত্যা চালায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। ১১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন জানায়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেবে তারা।

ময়মনসিংহ জেলা শান্তি কমিটি আজ ময়মনসিংহে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সভায় নিয়াজী ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত তার সম্প্রসারণবাদী লালসা চরিতার্থের জন্য আক্রমণ চালাচ্ছে। জনসভার পর কামালপুরে রাজাকারদের সমাবেশে তাদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানান নিয়াজী।

ভারতীয় হামলার অভিযোগে চট্টগ্রামে স্বাধীনতাবিরোধীরা হরতাল পালন করে এদিন। জুমার নামাজের পর একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে লালদীঘি ময়দানে জমায়েত হয়। ভারতীয় হামলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ হয়। জেহাদি উদ্দীপনা নিয়ে এখানে মিছিল করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। ভোলায় শাহ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির এক সভায় বক্তৃতা করেন ইলিয়াস আলী মাস্টার। সিরাজগঞ্জের এক সভায় মওলানা আসাদুল্লা সিরাজী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার আহ্বান জানান সবাইকে।

গভর্নর ড. মালিক আজ এক বেতার ভাষণে দেশের এই সংকটজনক অবস্থায় বিভ্রান্ত বা হতাশ না হয়ে ঐকবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল মোজাফফর হাসান নৌবাহিনীর সদস্যদের শত্রুকে কোনো সুযোগ না দিয়ে খুঁজে বের করে খতম করার নির্দেশ দেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
একাত্তর,বিজয়,মুক্তিযুদ্ধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close