প্রতীক ইজাজ

  ২৯ অক্টোবর, ২০১৮

মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক আজ

রাজনৈতিক চমকের অপেক্ষা এখন

শেষ হচ্ছে সংসদের কার্যকারিতা

আজ সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষদিন। এই অধিবেশন শেষের মধ্য দিয়ে সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী, চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, তার ক্ষণগণনাও শুরু হচ্ছে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে। সে হিসেবে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার শেষ কার্যদিবসও আজ। এ সরকারই আগামীকাল থেকে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পরিগণিত হবে। সে হিসেবে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক আজ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার এই বৈঠক বসার কথা রয়েছে। এই বৈঠকের দিকেই তাকিয়ে সবাই। কারণ এই বৈঠক থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে মন্ত্রিসভার আকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বৈঠক শেষে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের ঘোষণা দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেননা আগামীকাল থেকে অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকারের সময় বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেবল রুটিনওয়ার্ক করতে পারবেন। কোনো আইনপ্রণয়ন বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ফলে আজকের বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।

আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে কি না—সে বিষয়ে আজকের মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ বা আরপিও সংশোধনে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবটি পেশ হবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে তা জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে বিল আকারে উত্থাপন করা হবে, নাকি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুযায়ী সংশোধিত আরপিও আইনে রূপ নেবে; সে সিদ্ধান্তও হবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তবে প্রস্তাবটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপন হলেও পাস হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ একটি বিল পাসের জন্য সংসদে রিপোর্ট উত্থাপন থেকে শুরু করে ন্যূনতম তিন দিনের সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু আজ চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন। ফলে সংশোধিত আরপিও আইনে রূপ দিতে হলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।

একইভাবে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আগামীকাল থেকে বর্তমান সংসদ সদস্যরা আর বর্তমান পদমর্যাদায় থাকতে পারবেন না। ঠিক একইভাবে মন্ত্রীরাও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না। কেবল রুটিনওয়ার্ক করতে পারবেন। ফলে আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরবর্তী করণীয় ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।

এ ছাড়া বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব দাবি জানিয়ে আসছে এবং গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে এ ব্যাপারে যে চিঠি দিয়েছে, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত আসতে পারে আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে। বিশেষ করে এসব বিষয়ে সরকারবিরোধীদের যে সংলাপের দাবি, তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে মন্ত্রিসভার বৈঠকে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বর্তমান সংবিধানে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে তিন মাসের ক্ষণগণনা শুরু হলে সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। সংবিধান অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। এ ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’

এই নীতিনির্ধারকরা আরো জানান, তফসিল ঘোষণার প্রায় ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা হিসাব করা হয়। সে হিসেবে আজ বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ছোট আকারের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। অথবা এই মন্ত্রিসভা বহাল রাখতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এ ব্যাপারে সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

বিশেষ করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার আকার কেমন হবে—এ নিয়ে নানা মত সরকারের ভেতর ও বাইরে। এত দিন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলে আসছিলেন, ২০১৩ সালের মতো এবারও ভোটের আগে ‘ছোট পরিসরের নির্বাচনকালীন’ মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। চলতি বছরের শুরুতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নিজেও তেমনই আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার ছোট নাও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় ‘সব দলের’ প্রতিনিধিই আছেন। আর নির্বাচনকালীন সরকারের আকার ছোট করা হলে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মন্ত্রিসভা ছোট করা হলে একজনকে কয়েকটা মন্ত্রণালয় চালাতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দু-তিন মাসের জন্য থমকে যেতে পারে। এ বিষয়গুলোও ভাবতে হবে। ফলে নির্বাচনের সময়কার সরকার ঠিক কেমন হবে, তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। এর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ছোট সরকার গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা। সে হিসেবে বিএনপিকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সে সরকারে না এসে নির্বাচন বর্জন করেছিল। এবারও শেখ হাসিনা অনুরূপ একটি ছোট আকারের সরকার গঠন করবেন, নাকি নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকারই কাজ চালিয়ে যাবে; তা আজকের বৈঠক থেকেই জানা যেতে পারে।

এসব ব্যাপারে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, শুক্রবারে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি ও পার্লামেন্টারি কমিটির যৌথসভায় অনেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তবে এটা ঠিক, দু-একদিনের মধ্যেই পুরো দেশে নির্বাচনী আবহ চলে আসবে। সবাই নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

সংবিধান অনুযায়ী, ৩১ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। আগামী ১ নভেম্বর পাঁচ নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করবেন। ইতোমধ্যে একটি খসড়া তফসিল তৈরি করা হয়েছে। তবে তাতে ভোট গ্রহণের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসির আলোচনার পর ভোট গ্রহণের দিন চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে ইসির সূত্রগুলো। এসব সূত্র মতে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর নির্বাচনের তফসিল নিয়ে সভা করবে নির্বাচন কমিশন। ৪ বা ৫ নভেম্বর ওই সভা হতে পারে। এরপর রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। ওই ভাষণেই সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সাধারণত তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ৪০-৪৫ দিন সময় রেখে ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ১৮ থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো এক দিন ভোটগ্রহণ হতে পারে বলে আলোচনা আছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। একটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, অন্যটি আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। ফলে আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা আগামীকাল থেকেই সংসদ সদস্যদের যেমন সাংবিধানিক পদমর্যাদা থাকবে না, তেমনি মন্ত্রিরাও আর নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার পর নির্দলীয় সরকার গঠন, ইসি পুনর্গঠনসহ সরকারবিরোধীদের বেশ কিছু দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে নতুন করে মাঠে নামার আভাস দিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো। সূত্র মতে, প্রকাশ্যে না হলেও দলের ভেতরে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি আছে। নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হলে তফসিল ঘোষণার পরপরই নিজ দলের মনোনয়ন ও শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা হবে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের মুখপাত্র নজরুল ইসলাম খান বলেন, ন্যূনতম নির্বাচনী পরিবেশ ছাড়া ভোটে জনগণের মতামত প্রাধান্য পাবে না। বিএনপি বহু নির্বাচন করেছে। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপি সব সময় প্রস্তুত।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চমক,মন্ত্রিসভা,বৈঠক,সংসদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close