জুবায়ের চৌধুরী

  ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

রাজধানীর নিরাপত্তা

বসছে ১৬ হাজার সিসি ক্যামেরা

সড়কের মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে যুক্ত ঘূর্ণায়মান ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাটি পর্যবেক্ষণ করছে চারপাশ। ক্যামেরাটির সঙ্গে সংযুক্ত শব্দ শনাক্তকারী যন্ত্র বা সাউন্ড ডিটেক্টর যন্ত্র। হঠাৎ সন্দেহজনক শব্দে যন্ত্রটি শব্দের উৎসস্থল খুঁজতে শুরু করবে। শব্দ পেয়ে সিসি ক্যামেরার মুখ সেদিকে ঘুরে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই বার্তা চলে যাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষে। বোমা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দের উৎস সম্পর্কে থানা পুলিশকে মুহূর্তেই নির্দেশনা পাঠাবে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। যতক্ষণ পর্যন্ত গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তিটি (সন্ত্রাসী) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা না পড়বে, ততক্ষণ তাদের কেন্দ্রীয় অনুসরণ করবে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। না, এটি কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার কাজ এটি। রাজধানীতে এমন নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হচ্ছে ১৬ হাজার অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা।

১০ বছরে এ-সংক্রান্ত তিন প্রকল্পের ১০০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার পর এবার ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। উন্নত দেশের মতো রাজধানী ঢাকাকে ‘ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমে’ আনতে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর সার্বিক নিরাপত্তায় বসানো হচ্ছে ১৬ হাজার সর্বাধুনিক সিসি ক্যামেরা। অলিগলিসহ পুরো রাজধানীকে আনা হবে নজরদারির আওতায়। রাজধানীর আবদুল গণি রোডে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হবে এসব ক্যামেরা। নিয়ন্ত্রণকক্ষটিকে শিগগিরই ১৫-তলায় রূপান্তর করা হবে। এর বাইরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ৫০ থানাসহ রাজধানীর ৭০টি স্থানে মনিটরিং সেন্টার স্থাপনের কাজও চলছে। এই ক্যামেরায় যেকোনো বস্তুর স্পষ্ট ছবি দেখা যাবে। এটা দিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও গাড়ির নম্বর প্লেটও শনাক্ত করা যাবে।

ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই শেষে এই মেগা প্রকল্প চূড়ান্ত করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে এটি ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ক্যামেরা স্থাপনের পর অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। আর সফলতা পাওয়া গেলে, ধীরে-ধীরে এ প্রকল্প দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয় সম্প্রসারিত হবে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’ নামে এ প্রকল্পের পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের পক্ষে ওই প্রকল্পটি দেখভাল করছে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) গাজী মোজাম্মেল হক। তিনি জানিয়েছেন, প্রকল্পের আওতায় সিসি ক্যামেরা ছাড়াও পুলিশ সদস্যদের যোগাযোগের জন্য থাকবে ফোরজি মডেলের ওয়াকিটকি। এ ছাড়া অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারবেন।

জানা গেছে, প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হওয়ার পর তিন শিফটে পুলিশের অতিরিক্ত দেড় হাজার জনবলের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ১০৭ জন থাকবেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। পুরো প্রকল্পটি হবে রাজধানীর ৫০ থানায়। রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষ এ প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী এখন পর্যন্ত এটি পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় পুলিশের জন্য এক বছরে মোট বরাদ্দ করা বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি। চলতি অর্থবছরেও (২০১৭-১৮) উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন মিলিয়ে পুলিশ বাহিনীর জন্য বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট ১২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। তবে এ প্রকল্পের ব্যয় সংকুলান হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাজেট থেকে।

এদিকে, মেগা এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এর আগে রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ পুলিশের তিনটি বড় প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ১০ বছর আগে নেওয়া এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। আগের তিনটি প্রকল্পের টাকা কী করে পানিতে গেল, তা নিয়ে পুলিশের একেক কর্মকর্তা একেক ধরনের কথা বলেন। তবে সবারই অভিমত, যাচাই-বাছাই না করে প্রকল্প হাতে নেওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এও মনে করছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীতে বসবাস করা মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা আছে, তা আর থাকবে না।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নগর-পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক ব্যবস্থা। কিন্তু পুরো নগর অব্যবস্থাপনার কারণে এটি কাজই করছে না। সিসি ক্যামেরা দিয়ে পুরো রাজধানী ঢেকে দিলেও কোনো কাজ হবে না। যদি এর পেছনের লোকরা সৎ এবং দক্ষ না হন। উল্টো এ দিয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।

ডিএমপির দেওয়া তথ্য বলছে, গত দুই বছরে রাজধানীর ৫০টি থানায় ৬১৬টি, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও এর আশপাশে ৬৯২টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। গুলশান, বারিধারা ও নিকেতন সোসাইটির সহযোগিতায় ওইসব এলাকার পথে পথে বসানো হয়েছে ৮৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পুলিশের একক উদ্যোগে রাজধানীর প্রবেশমুখগুলো ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিন হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এসব ক্যামেরায় অপরাধের ফুটেজ দেখে আসামিও শনাক্ত হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামি শনাক্ত হলেও তাদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আবার এর ব্যতিক্রমও আছে।

যেমন ২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক, ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার, ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অনেকে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। সর্বশেষ গত বছরের ৫ ডিসেম্বর বনানীতে মুন্সী সিদ্দিকুর রহমানের খুনিদের ছবিও মিলেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। এরইমধ্যে দুই খুনি নিহত হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নিরাপত্তা,রাজধানী,সিসি ক্যামেরা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close