জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

‘চলন্ত বোমায়’ মৃত্যুঝুঁকি!

৫ বছর পরও অপরীক্ষিত ৩ লাখ যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার

বর্তমান সভ্যতা অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর। আর এই যন্ত্রনির্ভর সময়ে যন্ত্রণারও শেষ নেই। তবে সেই যন্ত্রণা যাতে প্রাণঘাতী না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরি। তাই ব্যবহৃত যন্ত্রটির নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিচর্যার প্রয়োজন। দেশে গত ১৫ বছরে প্রায় চার লাখেরও বেশি যানবাহন জ্বালানি সাশ্রয় করতে সিএনজিতে (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) রূপান্তর করা হয়। এসব যানবাহনে প্রতিস্থাপিত সিলিন্ডার প্রতি পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়ম আছে। এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, দেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তাই দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি সিলিন্ডারযুক্ত যানবাহনগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতোই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব গ্যাস সিলিন্ডার যেন এক একটি প্রাণঘাতী বোমা! এই ‘চলন্ত বোমায়’ যানবাহনের চালক ও যাত্রীর জীবনও মৃত্যুঝুঁকিতে! রিটেস্টিংবিহীন চরম ঝুঁকিপূর্ণ তিন লক্ষাধিক ‘সিলিন্ডার বোমা’ বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারে সংযুক্ত অবস্থায় চলছে রাস্তায়। যেকোনো মুহূর্তে এ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ডেকে আনতে পারে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতিসহ ভয়াবহ সর্বনাশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে এর ভয়াবহতা তাজা বোমার চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। তাই যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি। সিএনজিচালিত এসব যানবাহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত সিলিন্ডার প্রতি পাঁচ বছর পরপর রিটেস্ট (পুনঃপরীক্ষা) করার বিধান রয়েছে। গাড়ির ফিটনেসের সঙ্গে সিলিন্ডার রিটেস্ট বাধ্যতামূলক করা সত্ত্বেও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সব ধরনের সিলিন্ডার রিটেস্টের অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। আর যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় ‘সিলিন্ডার বোমায়’ যানবাহনের চালক-যাত্রীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএনজি সিলিন্ডারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে তিন হাজার পাউন্ড চাপে যখন গ্যাস ভরা হয় তখন রাস্তায় চলাচলকারী এক একটি গাড়ি এক অর্থে ‘চলন্ত বোমায়’ পরিণত হয়। গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার ছাড়া গ্যাসও উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে। তাই মজবুত সিলিন্ডার না হলে বড় রকমের অঘটন কিংবা প্রাণহানির ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে বড় বাস-ট্রাকের বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ বাস-ট্রাকগুলোতে ছয় থেকে আটটি সিলিন্ডার থাকে। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ ও দেশীয় পদ্ধতিতে জোড়া-তালিতে তৈরি করা সিলিন্ডারে বড় মাত্রার গ্যাস চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি, ছোট-খাটো দুর্ঘটনা বা ধাক্কাতেও সিলিন্ডারটি ভীষণ শক্তিতে বিস্ফোরিত হবার আশঙ্কা থাকে। সম্প্রতি টাঙ্গাইল, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সংঘটিত অন্তত ১১টি সাধারণ দুর্ঘটনায় পুরো যানবাহন পুড়ে গেছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে গবেষণা করছেন রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সাউদার্ন অটোমোবাইলস লিমিটেডের ম্যানেজার আমির হামজা। তিনি জানালেন, প্রতি পাঁচ বছরের অন্তর গাড়িতে লাগানো গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বিস্ফোরক অধিদফতরে রিপোর্ট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ৩০ শতাংশেরও কম সিলিন্ডার পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা হচ্ছে। ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার মালিকরা বেশি উদাসীন। আবার ঝুঁঁকি জেনেও ৬০ শতাংশ কমার্শিয়াল যানবাহনের মালিক পরীক্ষার ধার ধারেন না। তিনি বলেন, ঝুঁকি এড়াতে নির্ধারিত সময়ের বাইরে একদিনও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করা উচিত নয়। শুধু সিলিন্ডার পরখ করলেই হবে না, সিলিন্ডারের মুখের সেফটি ভাল্বও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কারণ এই ভাল্বের কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটছে।

জানা যায়, সারা দেশে এমন ৫৮৭টি প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তরকারী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে রিটেস্ট সেন্টার আছে মাত্র ১৩-১৪টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার সিলিন্ডার গ্যাস রিটেস্টের ক্ষেত্রে যানবাহন মালিকদের চরম উদাসীনতা রয়েছে। প্রাইভেটকার মালিক পরিবার নিয়ে গাড়িতে যাতায়াত করেন। তারপরও পাঁচ বছর পার হলেও গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারের রিটেস্ট করেন না। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিটি গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের জন্য দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। লিটার-ভেদে বিভিন্ন ধরনের মাশুলও গুনতে হয়। এসব খরচ ২ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এ কারণে গাড়ির মালিকরা এ প্রক্রিয়াকে বাড়তি খরচ ও সময় নষ্ট বলে মনে করেন। আরেকটি বড় কারণ হলো, প্রয়োজনের তুলনায় দেশে সিলিন্ডার রিটেস্ট সেন্টার নেই।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮০ সিএনজি কনভার্সন ওয়ার্কশপ রয়েছে। দেশে ১৫ বছর ধরে সিএনজিচালিত গাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত সারা দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ তিন হাজার ১৩১টি। এর মধ্যে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৫০৬টি যানবাহন সিএনজি ব্যবহারের জন্য রূপান্তরিত। এক লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি অটোরিকশা এবং ৪০ হাজার ৩৮৩টি বাহন গ্যাসচালিত বাহন হিসেবে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত যেসব বাহন রূপান্তরিত এবং নিবন্ধিত হয়েছে, সেগুলোর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সময় হয়েছে এ বছরের জুনে। আরপিজিসিএল এবং বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদোত্তীর্ণ ৯৪ হাজার সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হলেও বাকি তিন লক্ষাধিক সিলিন্ডার আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও রিটেস্ট করা হয়নি।

এদিকে, ২০০৫ সাল থেকে যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করছে আরপিজিসিএল। সেখানে দেখা যায়, সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ২০০৫ সালে দুটি, ২০০৬ সালে সাতটি, ২০০৭ সালে সাতটি, ২০০৮ সালে আটটি, ২০০৯ সালে পাঁচটি, ২০১০ সালে পাঁচটি, ২০১১ সালে ছয়টি, ২০১২ সালে পাঁচটি, ২০১৪ সালে ১০টি, ২০১৬ সালে চারটি এবং ২০১৭ সালে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের তথ্য আরপিজিসিএলের কাছে নেই। চলতি বছরের ১৭ জুলাই টাঙ্গাইলে একটি মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু হয়। এর আগে ৩ জুন নোয়াখালীতে একটি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন মারা যান। এর আগে চলতি বছর শুরুর দিকে আশুলিয়ার ডেল্টা সিএনজি ফিলিং স্টেশনে একটি প্রাইভেটকারে সিএনজি গ্যাস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে গাড়ির মালিকসহ দুইজন নিহত হন। আরপিজিসিএলের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, গত প্রায় তিন বছরে দেশে সিএনজিচালিত ১৭৫টি গাড়ি বিস্ফোরণে প্রায় ৪০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে।

আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক মহম্মদ আলী জানান, গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডারে প্রতিদিন যে সংকোচন-প্রসারণ হয়, এতে সিলিন্ডারের সহনীয়তার মাত্রা কমতে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সিলিন্ডারে ক্ষয় হয়, পুরুত্ব কমে যায়। এ ছাড়া সিলিন্ডারের ভাল্বের কার্যক্ষমতাও কমে যায়। তাই পাঁচ বছর পরপর তা পরীক্ষা করানো উচিত। যদিও একেকটি সিলিন্ডারের কার্যক্ষমতা ২০-৩০ বছর স্থায়ী হয়। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার অভাবে সিলিন্ডারের কার্যক্ষমতা কমে আসে। তাই বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। পরীক্ষা করে ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বদলে নিলে এ ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও জানান তিনি। আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক আরো জানান, সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা দায়িত্ব বিআরটিএর। গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করার সময় সিলিন্ডার পরীক্ষা করে দেখার কথা থাকলে তা মানছে না সংস্থাটি।

গাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের মেয়াদ এবং কার্যক্ষমতা জানতে ২০১৬ সালের ২৮ জুন একটি সার্কুলার জারি করেছিল বিআরটিএ। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া প্রতিবেদন পরীক্ষা করার পর ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করার কথা বলা হয় ওই সার্কুলারে। কিন্তু বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ফিটনেস নবায়নে সার্টিফিকেটের মূল কপি, ট্যাক্স টোকেনসহ বিভিন্ন কাগজপত্র চেয়ে একটি তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদের কথা বলা নেই। বিআরটিএর পরিদর্শকরা অন্যান্য কাগজপত্র দেখতে চাইলেও সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদ চান না। গাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদও নিয়ে আসেননি। বিআরটিএর পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, ফিটনেস নবায়নে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদ দেখার জন্য আদেশ জারি করে প্রতিটি কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন তারা। তবে সে আদেশ মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারেননি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গ্যাস সিলিন্ডার,বোমা,মৃত্যুঝুঁকি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close