নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

বদলে যাচ্ছে হাজারীবাগ

একসময় রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারিগুলোর বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্যে ক্রমাগত দূষিত হতো পরিবেশ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে হাজারীবাগের পানির রং হয়ে উঠেছিল কালো, ধূসর ও গাঢ় নীল। বেশির ভাগ কারখানায় ছিল না বর্জ্য পরিশোধনাগার। কারখানাগুলোর বর্জ্য সরাসরি ফেলা হতো নদীতে। যত্রতত্র ট্যানারি বর্জ্যরে উৎকট দুর্গন্ধে এ এলাকায় বসবাস করাই ছিল দায়।

ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ ও স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে গত বছর থেকে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেখানে ২০০ একর এলাকাজুড়ে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকে, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে এলাকার সার্বিক চিত্র। কিছুদিন আগেও কেউ এখানে বসবাসের চিন্তা করতেন না। এলাকাটি ছিল ট্যানারি শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। যে জমি বিনামূল্যে দিলেও কেউ নিতে চাইতেন না সেই হাজারীবাগ এখন হীরার টুকরায় পরিণত হয়েছে। হীরার দাম দিয়েও মিলছে না হাজারীবাগের এক টুকরা জমি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা হাজারীবাগ ঘিরে নানা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে। এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

একটি উন্নত আবাসিক এলাকার মতো এখানে থাকবে পার্ক, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট, ইনডোর গেমস, সুইমিংপুল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়সহ নানা ব্যবস্থা। এ বিষয়ে রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ট্যানারি মালিক অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় বাসিন্দা ও নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।

তিনি আরো বলেন, আমরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। তারা জানিয়েছেন, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় যে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার পূর্বে সেই এলাকার ভূমির মান বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে। এখানকার ভূমির পুনঃউন্নয়নে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বারোপ করেছেন। উন্মুক্ত স্থান বা জনসমাগমস্থল যেমন—পার্ক, খেলার মাঠগুলোতে সব শ্রেণি পেশার, বয়স ও পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা রেখে নকশা করতে হবে। বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতে পর্যাপ্ত জলাধার ও গাছপালা রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

‘বিশেষজ্ঞরা জানান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার উপযোগী করে ভবনের নকশা করতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী হিসেবে ভবন নির্মাণ এবং সেগুলো থেকে জরুরি প্রস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা একটি কমিউনিটি ভবনের ধারণা দিয়েছেন। যেখানে একই ভবনে কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট, ইনডোর গেমস, সুইমিংপুল ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকবে।’ হাজারীবাগ এলাকায় প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখা যায়, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার আয়তন ৫৯.৩৫ একর। এখানে ইমারতের মোট সংখ্যা ৮৫৫টি। এর মধ্যে শিল্প-কারখানা প্রায় ৬০০টি।’

স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব হাজি করম আলী জানান, ব্যবসায়ীদের হাজারীবাগ ছাড়ার ঘোষণার পরপরই এ এলাকার আবাসিক জমির গ্রাহক বেড়ে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জমির দাম।

ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর পরপরই এক লাফে যেন আকাশছোঁয়া মূল্য। বর্তমানে কোটি টাকায়ও এক শতাংশ জমি পাওয়া যাচ্ছে না।

ট্যানারি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত । পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করে ১৯৫০ সালে হাজারীবাগের ট্যানারি অঞ্চলে আনা হয়। বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণে থাকা ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া ট্যানারি শিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে।

২০০১ সালে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে সাভারে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। গত বছর ৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর সব কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফের বিষয়টি বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ট্যানারি কারখানাগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নের আদেশও বহাল রাখেন আদালত। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে হাজারীবাগে সব ধরনের ট্যানারি কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হন মালিকরা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হাজারীবাগ,ট্যানারি,বিষাক্ত বর্জ্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close