নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

শ্রমিক নয়, গণমাধ্যম কর্মী হচ্ছেন সাংবাদিকরা

বেতন-ভাতা ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী, সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৩৬, মিথ্যা বললে বা লিখলে জেল-জরিমানা

সব ধরনের গণমাধ্যম কর্মীর জন্য চাকরির শর্ত ঠিক করে একটি আইনের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে সরকার; যেখানে সাংবাদিকদের আগের মতো ‘শ্রমিক’ হিসেবে বর্ণনা না করে ‘গণমাধ্যম কর্মী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন ২০১৮’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া সম্প্রচার আইনের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

এই আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আগে গণমাধ্যম কর্মীরা চলতেন ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (চাকরির শর্তাবলি) আইন ১৯৭৪-এর আওতায়। পরে তাদের শ্রম আইনের অধীনে আনা হয়। শ্রম আইনের অধীনে গণমাধ্যম কর্মীদেরও ‘শ্রমিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। নতুন আইন পাস হলে গণমাধ্যম কর্মীরা আর শ্রমিক থাকবেন না, তাদের গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে অভিহিত করা হবে।

তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক গঠিত পরিদর্শন কমিটির অনুমোদনসাপেক্ষে গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির নিয়মাবলি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান প্রণয়ন করবে। এ ক্ষেত্রে কর্মীদের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা হবে সর্বোচ্চ ৩৬। এর বেশি হলে তাদের ওভারটাইম দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা গ্রুপ বিমার আওতায় অন্তর্ভুক্ত হবেন।

আইনে গণমাধ্যম কর্মীদের ছুটির বিষয়ে বলা হয়েছে, কর্মীরা বছরে ক্যাজুয়েল লিভ পাবেন ১৫ দিন। তাদের অর্জিত ছুটি জমা হবে ১০০ দিন। আগে তা ৬০ দিন ছিল। এ ছাড়া পূর্ণ বেতনে দুটি উৎসব ভাতা ও ১০ দিন উৎসব ছুটি পাবেন কর্মীরা। এ ছাড়া তিন বছর পর পর ৩০ দিনের জন্য সবেতন ছুটি পাবেন। এতে আরো বলা হয়, নারী গণমাধ্যম কর্মীরা সরকারি ছুটির মতো সমহারে মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর সুযোগ পাবেন। আইনে কর্মীদের ওয়েজ বোর্ড অনুসারে ন্যূনতম বেতন পরিশোধের পাশাপাশি তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। এই ফান্ডে কর্মীরা চাকরির এক বছরের মাথায় চাঁদা জমা দিতে পারবেন। মালিকপক্ষকেও ওই ফান্ডে সমহারে চাঁদা জমা দিতে হবে। আগে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা দিতে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের চাকরির বয়স দুই বছর পূর্ণ হতে হতো।

আইনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম কর্মী ও মালিকপক্ষের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হলে ‘এডিআর’র মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। মালিকপক্ষকে এই আইনের সব বিধান পালন করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে বা লঙ্ঘিত হলে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও জরিমানা অনাদায়ে আদালত কারাদণ্ড দিতে পারেন।

‘সম্প্রচার আইনটি নতুন জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে আইনটি তৈরি করা হয়েছে। অনলাইন গণমাধ্যমের সংজ্ঞা, কেবল অপারেটর, কেবল টেলিভিশন চ্যানেল, কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের এবং সম্প্রচারের সংজ্ঞা উল্লেখ করা আছে। এ ছাড়া আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন ও প্রচার, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান তথা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়া বার্তার নির্দেশ অমান্য করা, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং রাষ্ট্রের আদর্শ পরিপন্থী অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য সাজার কথা উল্লেখ করে শফিউল আলম বলেন, সম্প্রচারকারীর অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ কোটি টাকা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অপরাধ সংগঠন চলমান থাকলে প্রতি দিবসের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা। এটা টেলিভিশন, অনলাইন বা রেডিও হতে পারে। আর অনেকগুলো অযোগ্যতা সত্ত্বেও সম্প্রচার চালিয়ে গেলে যেমন—আদালত কর্তৃক বিকৃত মস্তিষ্ক, দুই বছরের অধিক কারাদণ্ড হওয়া, লাইসেন্স বাতিলের পাঁচ বছর পার না যাওয়া, দেউলিয়া হওয়া, ঋণখেলাপি হওয়া, এগুলোর পরও যদি কেউ চালিয়ে যান তাহলে শাস্তি হলো অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এটা চলমান থাকলে দৈনিক এক লাখ টাকা জরিমানা।

কমিশনের কাছে নালিশ করার বিধান রাখা হয়েছে। অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে। শাস্তির জন্য সরকারের কাছে আপিল করা যাবে। সম্প্রচার বা অনলাইন গণমাধ্যম কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রত্যেক অপারেটর বা তার কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ভোক্তাদের অসুবিধা বা নালিশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য উপস্থাপন করতে পারবেন।

আইনে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠিত হবে। সার্চ কমিটির সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে। রাষ্ট্রপতি একজন চেয়ারম্যানসহ কমিশন গঠন করে দেবেন। তার মধ্যে একজন নারী কমিশনারও থাকবেন।

কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতা হলো, বাংলাদেশের নাগরিক না হলে, জাতীয় সংসদ সদস্য বা স্থানীয় সরকারের যেকোনো স্তরের জনপ্রতিনিধির জন্য নির্ধারিত কোনো পদে নির্বাচিত বা নিবৃত হলে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি বা দেউলিয়া অথবা অপ্রকৃতস্থ হলে, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভবান পদে থাকলে, কোনো সম্প্রচার বা গণমাধ্যম শিল্প সংক্রান্ত ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে এবং সম্প্র্রচার প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত থাকলে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

কমিশনারের যোগ্যতা বলতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সম্প্রচার, গণমাধ্যম শিক্ষা, আইন, জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনা, ভোক্তা বিষয়াদি বা ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞানের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা।

চেয়ারম্যান এবং কমিশনারের পদের মেয়াদ তাদের নিয়োগের পাঁচ বছর বা তারা ৭০ বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। আর শারীরিক বা মানসিকভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত থাকলে তাকে অপসারণ করা যাবে। কমিশনের তিনজনের উপস্থিতিতে কোরাম হবে। সভা করার জন্য কোনো সময় দেওয়া নাই, তবে চাইলে সাত দিনের মধ্যে সভা আহ্বান করা যাবে।

কমিশনের কাজ হলো—সম্প্রচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করা এবং সম্প্রচার মাধ্যমের মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা, সম্প্রচার মাধ্যমে মতপ্রকাশ এবং সম্প্রচার মাধ্যমে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতি ও মানদণ্ড অনুসরণ, সম্প্রচার ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সম্প্রচার কার্যক্রমের পরিচালনার প্রতিযোগিতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির পথ সুগম করা, নতুন লাইসেন্স ও নিবন্ধন প্রদানের জন্য নির্দেশনা প্রদান, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমে যথা ডিজিটাল বা কোনো সম্প্রচার মাধ্যম সম্প্রচার যন্ত্রপাতির জন্য সম্প্রচারকারীর অনুকূলে লাইসেন্স ইস্যুর জন্য সুপারিশ করা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গণমাধ্যম কর্মী,শ্রমিক,সাংবাদিক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close