নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ আগস্ট, ২০১৮

ইভিএমের ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত ইসির

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোট গ্রহণের বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী সপ্তাহে আইনটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া অনুমোদিত আরপিওর সংশোধনী প্রস্তাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় রাখা হয়নি সেনাবাহিনীকে।

নির্বাচন ভবনে আরপিও সংশোধনসংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মো. নুরুল হুদা সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এ সময় তিন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন ভবনে সিইসির সভাপতিত্বে দুই দফা বৈঠক করে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে ইভিএমের বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বৈঠক বয়কট করেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

তবে এ ধরনের কমিশন সভা বয়কট ও নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার ঘটনার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৬ সালে ভোটার তালিকা নতুন করে নাকি হালনাগাদ করা হবে—এ নিয়ে সাবেক এম এ আজিজের কমিশনের দুজন কমিশনার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। বিরোধিতা করা দুজন কমিশনার হলেন মুন্সেফ আলী ও এ কে মোহাম্মদ আলী। একই সঙ্গে বর্জন করেছিলেন ওই সংক্রান্ত সভাও। এর আগে ২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা নির্বাচন অগ্রাধিকার দিতে কমিশনকে চাপ প্রয়োগ করার কারণে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ ওই কমিশনার চেয়েছিলেন উপজেলা নির্বাচনের চেয়ে ভোটার তালিকা প্রণনয় কার্যক্রম গ্রহণ করা শ্রেয়। এ ছাড়া কমিশনের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিশনারদের মধ্যে দ্বিমতের ঘটনা আরো ঘটেছে বলে ইসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে।

বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ৭২-এর কিছু সংশোধনের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়ে জাতীয় নির্বাচনে এই বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদে পাঠানোসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আইনটি সংশোধন হবে।’ তিনি জানান, মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকলেও কমিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতের ভিত্তিতে সংস্কারের পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিইসি আরো বলেন, ‘উনি (মাহবুব তালুকদার) ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা চারজন সম্মত হয়েছি।’

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ তৈরির জন্য এই সংশোধনী আনা হয়েছে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না—এ বিষয়ে কমিশন এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ইভিএম নিয়ে আইনে সংশোধনী আনা হবে। এটা নিয়ে আমরা একটা মেলা করব। সবার মতামত নেব। সেখানে পরিবেশ পরিস্থিতি যদি অনুকূলে থাকে, তখন সিদ্ধান্ত হবে। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যমে আমরা প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে রাখছি।’

২০১০ সালে ইভিএম চালু হয়। তবে এত দিন শুধু স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে এটি ব্যবহার করা হয়ে আসছে। সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান ইসি সচিব হেলালুদ্দীন। সাংবাদিকদরা এ বিষয়টি নজরে আনলে সিইসি বলেন, ‘এভাবে বলা তার উচিত হয়নি। কারণ, আমি স্পষ্ট করে বলছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইন আগে পাস হোক। সবার মতামত নিই। তখন যদি সম্ভব হয় একাদশে (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে দেখা যাবে।’ ইভিএম কেনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইভিএম কেনার বিষয়ে এখনো কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের নিজস্ব কিছু ইভিএম রয়েছে। আমরা সেগুলো দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চালাচ্ছি।’

এদিকে, বৃহস্পবিার বেলা ১১টার দিকে বৈঠক শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করেন। তিনি ইভিএম কেনার বিষয়ে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানান। সিইসির ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাহবুব তালুকদার আবার বলেন, ‘আমি এটার (ইভিএম ব্যবহারের) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মোটেই চাই না আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন হোক। কারণ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএম চায় না। এখন ওনারা বসে বসে আরপিও সংশোধন করতে থাকবেন আর আমি সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পর মূর্তির মতো বসে থাকব, এটা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি।’

মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘ওনারা ওনাদের কাজ করুন আমি আমার কাজ করি। তাই সভা থেকে বেরিয়েছি, কারণ আরপিও সংশোধনের বিষয় সভার কার্যপত্রে ছিল।’ ইভিএমসহ নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ইসি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রাখতে না পারার জন্য হতাশার কথাও জানান এই নির্বাচন কমিশনার। বলেন, ‘আমরা তো আমাদের কথা রাখতে পারছি না। আমরা বলেছিলাম সব দলের ঐকমত্য ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করব না। প্রথম থেকেই বলে আসছি, সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। রোডম্যাপের কোথাও ইভিএম নেই।’

সিইসি বলেছেন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আইনি সুযোগ রাখার উদ্যোগ নিলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেননি তারা। মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি পাঁচ টুকরার এক টুকরা। আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ নই, সংখ্যালঘিষ্ঠ। আমি এখনো মনে করি, সংসদ নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি। আমি তো গণতন্ত্রমনা মানুষ। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করলে তখন নির্ধারণ করব। তখনকার অবস্থা কী হবে, তা তো এখন বলতে পারি না।’ কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত থাকলেও ইসির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে চান না মাহবুব তালুকদার। বলেন, ‘আমি বিপরীতে অবস্থান নিয়েছি, কারো বিরুদ্ধে নয়। এটা মতের বিরুদ্ধে ভিন্নমত। সিইসির বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করব না। অন্যের মতকে সাপোর্ট করতে হবে, এ ধরনের নীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে।’

এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে বিধি সংশোধনের ক্ষেত্রেও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার। ইভিএম নিয়ে তার বিরোধিতাও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসিকে ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)।

‘নির্বাচনব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করতে চায় ইসি। অবশ্য ১৯ আগস্ট এই প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

এই হযবরল অবস্থার মধ্যেই গত জুলাই থেকে ইভিএম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এজন্য ঋণপত্র খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক। চীন, হংকংসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এনে বিএমটিএফ তা নির্বাচন কমিশনকে সরবরাহ করবে বলে নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। ইতোমধ্যে ৭৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরপিও সংশোধন,ইভিএম,নির্বাচন কমিশন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close