প্রতীক ইজাজ

  ১১ আগস্ট, ২০১৮

নির্বাচনের বাকি সাড়ে ৪ মাস

অরাজকতা ঠেকাতে প্রস্তুত সরকার

এ বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভোট বর্জন ও সহিংসতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ‘কোনো কোনো মহলের’ অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাব্য ‘অপচেষ্টার’ বিষয়ে জনগণকে সতর্কও করেছিলেন তিনি। এর ঠিক আট মাসের মাথায় এসে ঠিক একইভাবে সেই অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের কথা পুনর্ব্যক্ত করছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে সম্প্রতি শেষ হওয়া কোটা ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সরকারের কাছে এই ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়েছে বলেও মনে করছেন সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতে, ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন ইস্যুতে অনুপ্রবেশ করে সরকারবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এই চক্র একদিকে যেমন নির্বাচনী বছরের একেবারেই শেষ দিকে এসে সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে চায়; তেমনি এর মধ্যে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের গন্ধও মিলছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শেষ হওয়ায় সাময়িক স্বস্তি ফিরলেও উদ্বেগ কাটেনি সরকারের। আগামীতে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে। এর আগে অনুরূপভাবে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ক্ষমতাসীনদের।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীসহ স্বার্থান্বেষী মহল নানা বিষয়ে ইস্যু তৈরি করছে। আবার অনাকাক্সিক্ষত কোনো ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠছে। এর মধ্যে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ওই গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর স্ট্যাটাস, অডিও এবং ভিডিও ক্লিপ প্রচারের মধ্য দিয়েও তারা সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে বিএনপি ও তার জোট জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরাও জড়িত বলে মনে করা হচ্ছে।

কয়েকদিন ধরে এসব আশঙ্কার কথা প্রকাশ্যেই বলছেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা। গত বৃহস্পতিবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাওয়ায় আপাতত স্বস্তি ফিরলেও ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি বলে সবাইকে সতর্ক করেছেন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আগে গত ১৯ জুন তিনি ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক-এগারোর কুশীলবরা আবারও নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বোনার গোপন চক্রান্ত করে যাচ্ছে। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই ষড়যন্ত্রের জন্য ড. কামাল হোসেনকে দায়ি করেন। গতকাল তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ড. কামাল হোসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একাট্টা হয়ে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রী পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দিয়ে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ ঘটিয়ে কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন বলেও দাবি করেন। একইভাবে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা আগেও বসেছিল না, এখনো বসে নেই। ওরা ষড়যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস করে। তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও আওয়ামী লীগ কী ভাবছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি কেমন—জানতে চাইলে সূত্রগুলো বলছে, সরকার ও দল সতর্ক। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কোনো পক্ষের কোনো ধরনের হুমকি-ধমকি আমলে নেওয়া হবে না। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি যদি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে, তা হলে সরকার তা কঠোর হাতে দমন করবে। প্রশাসন ও দলের সাংগঠনিক ঐক্যকে কাজে লাগানো হবে। এ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবেই বাকি সময়টা পার করতে চায় সরকার।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের কর্মকান্ড সম্পর্কে আগেই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেটাই ঘটল। আমাদের প্রস্তুতি ছিল। তাই ষড়যন্ত্র সফল হতে পারেনি। আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সচেতন ও সতর্ক। এর আগেও বিএনপি-জামায়েত জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনসহ সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশ ও দেশের জনগণকে রক্ষা করেছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র হলে তা মোকাবিলা করব।

সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের বাকি মাত্র সাড়ে চার মাস। এর মধ্যে কোনো অবস্থাতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দেওয়া হবে না। বিশেষ করে কোনো ইস্যুই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইস্যুতে রূপ দিতে দেওয়া হবে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সতর্ক পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়েছে। তবে কারো কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেবে না সরকার।

একইভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রস্তুত বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, যেকোনো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিরোধের প্রস্তুতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে ধৈর্য রেখেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রশাসন। এ জন্য প্রয়োজনবোধে সামনে পুলিশে ও জেলা প্রশাসনে রদবদল আসতে পারে।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচন সামনে রেখে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আসতে পারে, সে ব্যাপারে সরকার ও আওয়ামী লীগ আগে থেকেই সজাগ ও সতর্ক। সেজন্য নির্বাচনী রাজনীতি ও প্রচারণার পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলার কৌশলে এগোচ্ছে তারা। এ লক্ষ্যে দলের তৃণমূলেও দেওয়া হচ্ছে বিশেষ দিকনির্দেশনা। একই সঙ্গে ১৪ দলের শরিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমমনা শক্তিগুলোকেও পাশে রাখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

দলীয় সূত্র আরো জানায়, এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বছরে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্য ঠেকাতে দলের তৃণমূলকে নির্দেশ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলকে সতর্ক করার পাশাপাশি ওই চিঠিতে চার দফা নির্দেশনা ছিল। ডাকযোগে সাংগঠনিক জেলা ও উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কাছে এসব নির্দেশনার প্রথমটিতে বলা হয়েছে; সংবিধান ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। একই চিঠিতে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হবে, সে পরামর্শও ছিল। বিএনপি-জামায়াত পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকলে এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে কোনো ষড়যন্ত্র কোনো চক্রান্ত সফল হবে না বলেও তাদের বিশ্বাস। তাই নির্বাচনী বছরে দলের প্রাণশক্তি তৃণমূলের নেতাদের সতর্ক সজাগ ও এক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।

দলীয় সূত্রগুলো আরো জানায়, দশম জাতীয় সংসদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচন বানচালসহ অন্য ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে মাঠে আছে আওয়ামী লীগ। আগামীতে বিএনপি-জামায়াত যাতে কোনো রকম সহিংস কর্মকান্ডসহ ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করতে না পারে, সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রয়েছে তাদের সকল কর্মকান্ডের ওপর।

অন্যদিকে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হলে তা কঠোর হাতে দমন করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিগগিরই বিশৃঙ্খলার চেষ্টায় জড়িতদের জন্য কঠোর বার্তা আসতে পারে। ইতিমধ্যেই সারা দেশের একটি রাজনৈতিক চিত্র হাতে এসেছে সরকারের। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য মিলেছে। নির্বাচন সামনে রেখে কারা কী করতে পারে কিছুটা ইঙ্গিতও রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সেদিকে কড়া নজর রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্য সব গোয়েন্দা সংস্থা।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে যাতে করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে সেজন্য যে ধরনের তৎপরতা চালানো প্রয়োজন তা অব্যাহত আছে। তবে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সরকার,অরাজকতা,নির্বাচন,আইনশৃঙ্খলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close