প্রতীক ইজাজ ও গাজী শাহনেওয়াজ
সবার চোখ ৩ সিটিতে
নৌকা না ধানের শীষ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ছয় মাসের মতো বাকি। রাজনীতি ব্যস্ত মূলত সেই নির্বাচনকে ঘিরেই। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নানাভাবে মাঠের ভোটারদের মনোভাব এবং দলের জনপ্রিয়তা বোঝার চেষ্টা করছে। দলগুলো থেকে নানা জরিপও করা হচ্ছে। এসব সমীকরণের নানা হিসাব-নিকাষ নিয়েই আজ দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তাই নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে এই নির্বাচনে দেখা দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আবহ।
বিশেষ করে এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দল দুই ধরনের সমীকরণ নিয়ে এসেছে। একদিকে খুলনা ও গাজীপুরে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ায় আওয়ামী লীগ এই তিন সিটিতেও সেই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায়। অপরদিকে আগের দুই সিটিতে বড় ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ায় এই তিন সিটি দলের জন্য অস্তিত্ব রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির। মাঠের অবস্থা অতটা সুবিধাজনক না হওয়ায় দলটির লক্ষ্য অন্ততপক্ষে ভোটের ব্যবধান কমানো।
মাঠের অবস্থা যেমনই হোক; নির্বাচনে যেকোনো পক্ষই ছেড়ে কথা বলবে না—এমন আভাস মিলেছে দুই দল থেকেই। নানা অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের মেয়র প্রার্থীদেরই। তবে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আওয়ামী লীগ। এই তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের বিজয় দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা ও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। গতকাল রোববার তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে একটি প্রতিষ্ঠানের করা জনমত জরিপের তথ্য তুলে ধরে এই বিজয়ের কথা জানান তিনি। জয় লিখেছেন, ‘আমি যথেষ্ট আস্থা নিয়ে বলতে পারি, বরিশাল ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় হবে। সিলেটেও আমরা সামান্য এগিয়ে। তবে সেখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’ তবে মাঠ ছাড়তে নারাজ বিএনপিও। বিশেষ করে রাজশাহী ও বরিশালে বিএনপি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যেমন একদিকে উৎসবে রূপ নেবে; তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে।
এমন অবস্থার মধ্যেই আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ তিন সিটির নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে উৎসব ও শঙ্কা দুইটিই রয়েছে। শেষ মুহূর্তে গতকালও প্রকাশ্য প্রচার-প্রচারণা বন্ধ থাকলেও কর্মী-সমর্থকরা ব্যস্ত ছিল শেষ নির্বাচনী ছক আঁকতে। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটায় শেষ পর্যন্ত ভোটযুদ্ধ রূপ নেবে উৎসবেÑ এমনটাই আশা করছেন স্থানীয় ভোটাররা। সবার চোখ এই তিন সিটির দিকে। ভোট শেষে কে হাসে জয়ের হাসি নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ, নাকি ধানের শীষের বিএনপি—তা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন যেমন সুষ্ঠু ও বিশৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে, ঠিক তেমনি রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচন সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হবে। রাজশাহী সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বিশৃঙ্খলার যে আশঙ্কা করছেন তা মিথ্যা। নির্বাচন নিয়ে বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ নেই।
নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঠে নেমেছে র্যাব-বিজিবি। সকাল থেকেই পুরো সিটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল দেওয়া শুরু করেছে। ভোটের দিন পর্যন্ত এ পরিবেশ বজায় থাকবে বলে জানিয়েছেন সচিব।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী ও ভোটের মাঠের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তিন সিটিতেই ভোটারদের নজর মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের ঘিরেই। সিলেট ও রাজশাহীতে সাবেক মেয়ররাই পরস্পরের মুখোমুখি। বরিশালে আওয়ামী লীগে নতুন মুখ। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক তার সঙ্গেই থাকছে। দুই প্রধান দলের পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও বামদল আছে। রাজশাহী ও বরিশালে বামদল সরব। মাঠে জাতীয় পার্টি সক্রিয়। জোটের বাইরে গিয়ে ভোট করছে জামায়াত। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে কেউ মেয়র নির্বাচিত হবেন—এমনটা ভাবছেন না কেউই।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, তিন সিটিতেই শেষ পর্যন্ত প্রার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ বজায় ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিরা পরস্পরের আমলনামা তুলে ধরেছেন। গণমাধ্যম ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত সংলাপে পাশাপাশি বসেও মার্জিত ছিলেন তারা। মাঠের প্রচারণায় মাঠে বলার মতো কোনো সহিংসতা হয়নি। ফলে নির্বাচন যে সুন্দর ও উৎসমুখর পরিবেশেই হবে তা বলা চলে।
আজকের নির্বাচনে তিন সিটিতে ১৮ জন মেয়র প্রার্থী লড়ছেন। এর মধ্যে রাজশাহীতে পাঁচজন, বরিশালে ছয়জন এবং সিলেট সিটিতে সাতজন। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রচার এবং আলোচনায় সরকার সমর্থিত মেয়র এবং সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি প্রার্থীরা। তবে তিন সিটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী লড়ছেন পাঁজজন।
এর মধ্যে সিলেটে মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, ধানের শীষ নিয়ে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী, মই প্রতীক নিয়ে বাসদের আবু জাফর, হাত পাখা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন খান, টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, হরিণ প্রতীক নিয়ে মো. এহছানুল হক তাহের ও বাস প্রতীক নিয়ে মো. বদরুজ্জামান সেলিম লড়ছেন।
রাজশাহীতে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, ধানের শীষ নিয়ে বিএনপির মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির কাঁঠাল প্রতীক নিয়ে মো. হাবিবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাত পাখা প্রতীক নিয়ে মো. শফিকুল ইসলাম ও হাতী প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মুরাদ মোর্শেদ লড়ছেন।
বরিশালে মেয়র পদে লড়ছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, ধানের শীষ নিয়ে বিএনপির মো. মজিবর রহমান সরওয়ার, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাস্তে প্রতীক নিয়ে আবুল কালাম আজাদ, মই নিয়ে বাসদের মনিষা চক্রবর্তী, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে মো. ইকবাল হোসেন ও হাত পাখা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবাইদুর রহমান মাহাবুব।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। পাশাপাশি থাকছে দেশীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষকরা তো থাকছেনই। সব মিলিয়ে কেমন ভোট হয় তিন সিটিতে সেজন্য উন্মুখ হয়ে আছেন দেশের সাধারণ মানুষ। কারণ এ নির্বাচনের ফল বলে দেবে দোরগোড়ায় কড়া নাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে। গত শনিবার থেকেই তিন সিটিতে টহল দিচ্ছে র্যাব-বিজিবি।
রাজশাহীর রিটার্নিং কর্মকর্তা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, তার সিটিতে ৩০ ওয়ার্ডের ১৩৮ ভোট কেন্দ্রে কক্ষের সংখ্যা ১০২৬টি। মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ জন ও নারী ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন। তবে পুরুষের চেয়ে এখানে নারী ভোটার বেশি। এ সিটিতে মেয়র প্রার্থী পাঁচজন।
বরিশালের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, এ সিটির ৩০টি ওয়ার্ডে ১২৩টি ভোট কেন্দ্রে কক্ষের সংখ্যা ৭৫০টি। মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৬ জন ও নারী ১ লাখ ২০ হাজার ৭৩০ জন। তবে এ সিটিতে পুরুষ ভোটার বেশি। এ সিটিতে মেয়র পদে লড়ছেন ছয়জন।
সিলেটের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান বলেন, এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডে ১৩৪টি ভোট কেন্দ্রে কক্ষের সংখ্যা ৯২৬টি। এ সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন ও নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। তবে এ সিটিতে পুরুষ ভোটার বেশি। এ সিটিতে মেয়র প্রার্থী সাতজন।
পিডিএসও/হেলাল