গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৪ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধনের জন্য ৭৬ দলের আবেদন

হাস্যকর ভুল তথ্যে বিব্রত ইসি

নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা নতুন ৭৬ রাজনৈতিক দলের দেওয়া নানা তথ্যে রীতিমতো বিব্রত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জমা দেওয়া কাগজপত্রে নানা ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য। সেসব যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে রীতিমতো বিড়ম্বনায় পড়েছেন ইসির কর্মকর্তারা। এসব দল কি আদৌ আছে—নাকি শুধু নিবন্ধনের জন্যই এমন তথ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে সে নিয়ে ভীষণ বিভ্রান্তিতে পড়েছে ইসি।

ইসির যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দলের তথ্য যাচাই করে নিবন্ধনযোগ্য একটি দলও খুঁজে পাননি তারা। এমনকি সব শর্ত পূরণ করে অবশিষ্ট দলগুলোর মধ্য থেকে নিবন্ধনযোগ্য দল পাওয়া যাবে কিনা—তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে আবেদন বাছাই কমিটির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এরই মধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন নতুন দলগুলোর অগোছাল তথ্য সংযুক্ত দেখে। তারা বলেন, প্রায় সব দলের তথ্যে রয়েছে অসংখ্য বিভ্রান্তি। ভুলে ভরা এবং সাংঘর্ষিক শব্দও যোগ করেছে কোনো কোনো দল।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, শর্তপূরণ করে আবেদন করা হলে নিবন্ধন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই ইসির। তবে নতুন আবেদন করা দলগুলোর যে হাল, তাতে আদৌ এসব দল নিবন্ধন পাবে কিনা—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমনকি নতুন নিবন্ধিত অনেক পুরোনো দলের চিত্রও হুবহু। ফলে পুরোনো দলগুলোর অফিস কার্যালয় খুঁজতে মাঠে নামা হলে অনেক দল নিবন্ধন থেকে বাদ পড়বে।

এদিকে, নতুন আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে নিষিদ্ধ কিংবা জঙ্গি সম্পৃক্ত কোনো দল রয়েছে কিনা তা তদন্ত করে ইসিকে জানাতে চিঠি দিলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জবাব দেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তথ্যের জন্য নতুন করে তাগিদপত্র দেয়ার কথা ভাবছে ইসি।

ইসি জানায়, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিতে ৩০ অক্টোবর আবেদন আহ্বান করা হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর ছিল আবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন। দলগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করে এ মাসেই প্রাথমিকভাবে যোগ্য দলগুলোর কার্যালয় অনুসন্ধানে নামবে ইসি।

খোঁজ নিয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা নতুন দলগুলোর কাগজপত্র থেকে হাস্যকর সব তথ্য পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির গঠনতন্ত্র কপি-পেস্ট করে নিজ দলীয় গঠনতন্ত্র বলে চালিয়ে দিয়েছে একটি দল। এমনকি এক জায়গায় বিএনপির নামটি থাকলেও তা মুছে নিজেদের দলের নামটি বসাতেও ভুলে গেছে দলটি। আবার গঠনতন্ত্র লিফলেট ও ছাপানো আকারে দিয়েছে দু-একটি দল। তাদের তথ্য দেখে বোঝা যাচ্ছে, তদন্তে গেলে সব মিথ্যা হবে। ইসির আরেকজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, নতুন দলের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে পুরো ধাক্কা খেতে হচ্ছে। কোনো একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে তাদের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করেছেন।

ইসির কর্মকর্তারা আরো বলেন, নতুন দলের যে হাল তাতে নিবন্ধন পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমন পুরোনো দলগুলোর অবস্থাও নতুনগুলোর মতোই বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, পুরোনো দলের কার্যালয় ও শাখা অফিস খুঁজতে মাঠে নামলে অনেক দল নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

বাছাই কমিটির একজন উপসচিব বলেন, নিবন্ধনের জন্য আবদেন করা নতুন পাঁচ-ছয়টি দলের তথ্য যাচাই করেছি; একটিও নিবন্ধন পাওয়া মতো নয়। এসব দলের গঠনতন্ত্রে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দলের সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব থাকবে তা উল্লেখ নেই। প্রতিটি উপজেলায় ২০০ ভোটারের স্বাক্ষর থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও সে তথ্য মেলেনি। বিগত নির্বাচনে (নিবন্ধনের আগে) ওই দল কত শতাংশ ভোট পেয়েছে তার কোনো উল্লেখ নেই। এ থেকে বোঝা যায় দলগুলো মনগড়া তথ্য দিয়েছে। একটি দল তাদের ব্যাংকের স্থিতি দেখিয়েছেন মাত্র ১ হাজার টাকা; যা ভুয়া। এসব দল নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সব কাগজপত্র দিলেও তাতে তথ্যের ব্যাপক গরমিল রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির আরেক উপসচিব বলেন, দলের সর্বস্তরে নির্বাচিত নেতৃত্ব থাকতে হবে গঠনতন্ত্রে সেটি নেই। নিবন্ধনের শর্তানুযায়ী তৃণমূলের মতামত ও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি থাকবে। এমন শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দল জানিয়েছে, সভাপতি মনোনীত কয়েকজন নির্বাচিত হবেন। কোনো কোনো দল বিস্তারিত ঠিকানা না দিয়ে শুধু ছাতক, সুনামগঞ্জ এতটুকু উল্লেখ করেছে।

অন্য আরেক উপসচিব জানান, নিবন্ধনের আবেদনপত্রের সঙ্গে ৫ হাজার টাকার ট্রেজারি চালান দেয়নি কোনো কোনো দল। দলের গঠনতন্ত্র কী সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই বেশির ভাগ দলের। প্রধান কার্যালয়ের অফিস মসজিদ মার্কেট দেখিয়েছে একটি দল।

এই কর্মকর্তা বলেন, তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে রীতিমতো বিব্রত আমরা। একটি দল গত বছরের ২৭ নভেম্বর ইসিতে দল হিসেবে তাদের নিবন্ধন করতে আবেদন করেছে। অথচ ওই দলটি আবেদন জমা দেয়ার মাত্র দুই দিন আগে তাদের দলের অফিসের জন্য এক বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তি করার তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে একটি দলকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনে অন্তত একটি সংসদীয় আসন পেতে হবে অথবা যে কোনো একটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ওই আসনে প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পেতে হবে অথবা দলের একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে, অন্তত ২১টি প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কমিটি থাকতে হবে এবং অন্তত ১০০ উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণিক দলিল থাকতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, তিনটির মধ্যে একটি শর্ত পূরণ হলেই নিবন্ধনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

কিন্তু আবেদন করা দু-একটি দলের অফিস অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই প্রতিবেদক দেখেছেন, ‘বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস-বিজেসি’ নামে একটি নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। দলটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন নিজের যে ফ্ল্যাট বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন সেটাকেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবাসিক ভবনটি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ার বিজয় সরণি টাওয়ার নামে পরিচিত। আর ‘নাকফুল বাংলাদেশ’ নামক দলের আবেদনে অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানো হয়েছে রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বিএনএস সেন্টারের দশম তলা। কিন্তু সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। যে কক্ষটিকে দলীয় কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে সেটি একটি গার্মেন্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছে সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের তালিকা চেয়ে গত মাসে চিঠি দেয় ইসি। নিবন্ধনের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের সুবিধার্থে এ তালিকা চাওয়া হয়। ইসির উপসচিব মো. আবদুল হালিম খান স্বাক্ষরিত ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি মন্ত্রণালয়। আজ রোববার এ বিষয়ে কোনো তথ্য না পেলে তাগিদপত্র পাঠাতে পারে কমিশন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্বাচন কমিশন,ইসি,রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist