প্রতীক ইজাজ

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে এখনো সংশয়

নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তির দুই মাস পূর্ণ হয়েছে গত ২৩ জানুয়ারি। চুক্তি অনুযায়ী, এই দুই মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করার কথা দেশটির। কিন্তু চুক্তির অস্পষ্টতার কারণে বাংলাদেশ সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বাংলাদেশ বলেছিল, এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরি করে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোকে দেবে। মিয়ানমার সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেবে।

সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্টমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ শোয়েরের হাতে প্রত্যাবাসনের জন্য আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাদের পরিচয় যাচাই করবে দেশটি। তবে যাচাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।

এছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় দুই দেশের সীমান্তের ‘শূন্য রেখায়’ অবস্থানরত ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা যাতে তাদের এলাকায় ফিরে যেতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের সে দেশে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসক পর্যায়ে সভায় এসব রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

ফলে ঠিক কবে নাগাদ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করবে মিয়ানমার- তা এখনো নিশ্চিত নয় বাংলাদেশ। দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মুখে মিয়ানমার ফেরত নেওয়ার কথা বললেও তাদের সদিচ্ছা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চুক্তির কিছুই স্পষ্ট করে না দেশটি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে রোহিঙ্গাদের তথ্য দেওয়ার শর্ত দেয় মিয়ানমার। এজন্য রোহিঙ্গাদের তথ্য সংবলিত একটি ফরমও নির্দিষ্ট করে দেয় দেশটি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আজকের বৈঠকে মিয়ানমার নির্ধারিত প্রত্যাবাসন ফর্ম ধরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক একটি ছোট্ট তালিকা হস্তান্তর করা হতে পারে, যা ধরে মূলত প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমার সর্বোচ্চ দুই মাস সময় পাবে। গত ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের নেপিডোতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে সম্পাদিত ‘এগ্রিমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেস পারসন ফর্ম রাখাইন স্টেট’ মাঠ পর্যায়ের চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে বাংলাদেশ তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গতকাল মিয়ানমারকে তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী হওয়ার প্রমাণ ও তথ্য রয়েছে। আর স্বাক্ষর হওয়া চুক্তির ‘৬-এর (এ)’ ধারা অনুযায়ী, সম্ভব হলে দুই মাসের মধ্যে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সত্যতা নিশ্চিত করবে মিয়ানমার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখনো মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব হিসেবে বেশকিছু কারণের কথা জানান। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে মিয়ানমারের নেপিডোতে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ১০টি সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

এসবের মধ্যে ছিল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) গঠন। এছাড়া সীমান্ত লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন এবং নিয়মিত নিরাপত্তা ও সহযোগিতা বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। এরপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সীমান্তে লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন হয়নি। লিয়াজোঁ অফিসটি কবে, কিভাবে করা যায়, সে বিষয়ে গতকালও কোনো আলোচনা হয়নি।

এমনকি এখনো প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর গত প্রায় তিন মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরো ১০ হাজার ৫৮১ জন রোহিঙ্গা। সর্বশেষ গত বুধবারও বাংলাদেশে ঢুকেছে ২১৩ জন। এ নিয়ে গত বছরের ২৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২৩৬ জন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ চাইছে প্রস্তুতি চ‚ড়ান্ত করেই প্রত্যাবাসনে যেতে, যাতে মাঝপথে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া থেমে না যায়। এমনকি রোহিঙ্গারা যেন সেখানে স্থায়ীভাবে নাগরিক হিসেবে বাস করতে পারে, সে দিকটাও বাংলাদেশ নজরে রেখেছে। আশা করছি প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমার মাঝপথে আর থামাতে পারবে না।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিদের এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে এগিয়ে না আসলে উদ্ভ‚ত দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই বহন করতে হবে।

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক ক‚টনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এ জন্য ক‚টনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। বিশেষ করে চারটি বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা হত্যা, ধর্ষণ, ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। জাতিসংঘ একে এথনিক ক্লেনজিং বা জাতিগত নির্মূল অভিযানের একটি দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু মিয়ানমার এখনো তা অস্বীকার করছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, চুক্তিতে কী আছে তা নিয়ে তারা তেমন কিছুই জানেন না।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, এখনো মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো নিরাপদ নয়। রোহিঙ্গারা বলছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে, বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ হলে এবং নিপীড়ন বন্ধ হলেই তারা মিয়ানমারে ফিরবে। তবে তেমন অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। ত্রাণ সংস্থাগুলোরও এ নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো মানে তাদের মৃত্যুর মুখে আবার ঠেলে দেওয়া হবে বলে মনে করছেন এসব সংস্থার কর্মকর্তারা।

বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, ফেরত নেওয়ার পর রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পাবে কি না- সে ব্যাপারে কোনো সমাধান হয়নি। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয় না এবং তাদের ২০১৪ সালের জনগণনাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাদেরকে আসলে মিয়ানমারের বাসিন্দা বলেই স্বীকার করা হয় না। তাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করা হয়। নতুন চুক্তিতেও তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনকি ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গারা তাদের জমি ফেরত পাবে কি না- সে ব্যাপারেও কিছু বলা হচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, কমপক্ষে ৩৫৪টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুরো বা আংশিক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা কি এ জমি ফেরত পাবে, বা তারা কি প্রমাণ করতে পারবে যে এ জমি তাদের ছিল- তাও ঠিক নেই।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া পর্যন্ত সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। শুরুতে ফেরত যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংখ্যাও কম থাকবে। কারণ যেভাবে নির্যাতন করে তাদের তাড়ানো হয়েছে তাতে ফেরতে এখনো অনেকে আগ্রহী নন। বাংলাদেশকে ভালোভাবে মনিটর করতে হবে বিষয়টি। কিন্তু মিয়ানমার যদি তার অঙ্গীকার রাখে এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে তা হলে ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়বে।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, শুরুর দিকে দৈনিক ৩০০ করে সপ্তাহের পাঁচ দিনে ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। চুক্তিতে তিন মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করে এই সংখ্যা বাড়ানোর অপশন বা সুযোগ রাখা হয়েছে। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার যেন কোনো ছলচাতুরির সুযোগ নিতে না পারে। কারণ তারা চাইবে না সব রোহিঙ্গা ফেরত যাক। আন্তর্জাতিক চাপ যত দিন অব্যাহত থাকবে তত দিনই মিয়ানমার নমনীয় থাকবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মিয়ানমার,রোহিঙ্গা,রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন,রোহিঙ্গাদের ফেরত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist