প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৮

‘মি টু’ ক্যাম্পেইনে কেন অনুপস্থিত বাংলাদেশ

নীরবে যৌন হয়রানি সহ্য করার পালা সমাপ্তি ঘটাতে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে নতুন ধাঁচের সামাজিক আন্দোলন হ্যাস ট্যাগ ‘মি টু’। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে রাজনীতি, ব্যবসা, শিল্প-সংস্কৃতির জগতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তির যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে আসায় এই নীরবতা ভাঙার পালা শুরু হয়। বাংলাদেশে নীরবে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও তার প্রকাশ নেই, তাছাড়া এই প্রচারণাটি এখনো জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি।

কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ক্ষমতাশালী পুরুষের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারী কথা তখনই বলবে, যখন সে বিচারের সম্ভাবনা জানবে। কিন্তু এ সমাজ নিপীড়িত নারীকে আরো বেশি নিপীড়ন করে। এ কারণে এখানে বড় আন্দোলন গড়ে উঠলেও বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হেয়েছে।

হলিউডের শীর্ষস্থানীয় প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল নীরবতা ভাঙার পালা। যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘মি টু’ হ্যাস ট্যাগ দিয়ে জনপ্রিয় ক্যাম্পেইন চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বাংলাদেশের পারিবারিক পরিবেশ থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপর যে যৌন সহিংসতা চলছে, তা অনেকটা নীরবে এবং প্রতিবাদ ছাড়াই। সম্প্রতি জনপ্রিয় মডেল ফারহানা শাহরিন ফারিয়া তার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন মিডিয়া জগতের নানারকম যৌন হয়রানির কথা। তিনি বলেন, মিডিয়া জগতে কাজ করতে হলে তার ভাষায় ‘স্যাক্রিফাইস’ করতে হয়। ‘আমি ছিলাম লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৭-এর সেকেন্ড রানার আপ। মূলত যখন আমি বাংলালিংক কাস্টমার কেয়ারের বিজ্ঞাপন করি তারপর থেকে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বাজে প্রস্তাব পাই।’ বলেন ফারিয়া। এরআগেও তিনি ফেসবুকে লাইভ ভিডিওতে তুলে ধরেন নানারকম হয়রানির কথা।

তিনি জানান, সবসময়ই তিনি এ বিষয়ে প্রতিবাদ করে আসছেন। যার জন্য অনেক বড় বড় কাজ হারাতে হয়েছে তাকে। সরাসরি অফার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমাদের সঙ্গে ‘পার্সোনাল রিলেশন’ মেইনটেইন করতে হবে। কেন আমি পার্সোনাল রিলেশন রাখব? আমার কোয়ালিটি, বিউটি দিয়ে আমি কাজ করব। এই অফারগুলোর কারণে আমাকে অনেক কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। যেখানে আমার মনে হয়েছে আমার কোয়ালিটির চেয়ে ‘স্যাক্রিফাইস’টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কাজ দেওয়ার নাম করে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তার মত অনেকের কাছ থেকেই সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। কিন্তু এগুলোকে কতটা গুরুত্ব দেন ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব স্থানীয় পরিচালকরা?

চলচ্চিত্র পরিচালক প্রযোজক সোহানুর রহমান সোহান এ ব্যাপারে বলেন, ‘এখানে ভালো-খারাপ অনেক মানুষ আছে। কেউ ফিল্মকে হয়তো খারাপভাবে ব্যবহার করছে। তিনি (ফারিয়া) হয়তো এরকম কারো পাল্লায় পড়েছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর কাজ করছি। তবে আমার ক্ষেত্রে এমন কখনো ঘটেনি। আবার অনেক সময় কেউ কেউ আমাদেরও প্রস্তাব দিয়ে সুযোগ নিতে চায়, যেটা কখনো সম্ভব না।’ তবে অভিযোগ থাকলে প্রমাণ নিয়ে প্রযোজক বা পরিচালক সমিতিতে জানালে তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

হলিউডের যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর গত অক্টোবর মাসে বিবিসির এক জরিপে উঠে এসেছে, ব্রিটেনে কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাঙ্গনে অর্ধেক নারীই যৌন হয়রানির শিকার হন, এমনকি এক পঞ্চমাংশ পুরুষও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানির শিকার প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী জানান, ঘটনার পর তারা এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট করেননি বা কাউকে জানাননি।

অন্যদিকে, যৌন হয়রানির শিকার ৭৯ শতাংশ পুরুষ জানিয়েছেন বিষয়টি তারা নিজেদের মধ্যেই চেপে রেখেছিলেন। এছাড়া, প্রতি সাতজনে অন্তত একজন অযাচিত বা অশ্লীল স্পর্শের শিকার হয়েছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মি টু’ হ্যাস ট্যাগে অনেক নারী-পুরুষ জানিয়েছেন কীভাবে তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। হয়রানির প্রতিবাদে ‘মি টু’ হ্যাস ট্যাগ দিয়ে জনপ্রিয় ক্যাম্পেইন শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যৌন হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বেশ বড়সড় মিছিলও হয়েছে হলিউডে। প্রথমে আন্দোলনটি শুরু করেছিলেন সমাজকর্মী টারানা বার্ক এবং পরে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় অভিনেত্রী আলিসা মিলানো, প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ করার পর। এরপর আন্দোলনটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিজের ওপর ঘটে যাওয়া হয়রানির ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন।

এদিকে, বাংলাদেশে সরাসরি যৌন হয়রানির শিকার হয়েও মুখ খুলতে চান না অনেক নারী। ঢাকার বনশ্রী এলাকার একজন নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি কাজ করতেন নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বসের দ্বারা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে শেষমেশ চাকরি ছেড়ে দিতেই বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘একদিন গিয়ে ডেস্কে বসেছি। আমার ব্রাঞ্চের একজন বস আমাকে ফোন দিয়ে বলে ‘আজ কি রঙের ব্রা পরে এসেছো?’ আমি তো শক্ড হয়ে গেলাম। পরে বললাম আপনাকে একটা থাপ্পড় মারব। সে বলে মারো, তাও ভালো...। আবার একদিন মেসেঞ্জারকে দিয়ে সিনেমার টিকেট কাটিয়ে এনে খবর দিয়েছে—‘স্যার আপনাকে নিয়ে সিনেমায় যাবে।’ মেসেঞ্জারদের মাধ্যমে এভাবে চাউর করা হত, আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হত। পরে আমি বাধ্য হলাম চাকরিটা ছেড়ে দিতে।’ কিন্তু তিনি কখনো বিষয়টি প্রকাশ করতে পারেননি। চেষ্টা করেছেন বদলির তাও না পেরে নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

২০১৬ সালে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ সিএইচআরআই-এর গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশের পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন। আর উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শকদের শতকরা তিন ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন। ওই রিপোর্টে বলা হয়।

২০১৭ সালের শেষে এসে আইন ও শালিস কেন্দ্র জানায়, এক বছরে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮১৮ জন আর ধর্ষণের পর হত্যার শিকার প্রায় অর্ধশত। এমনকি সাংবাদিকতা পেশায় কর্মরত নারীদেরও যৌন নিপীড়নের মুখে পড়তে হয়। পুলিশ, সরকারি অফিস, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন যৌন হেনস্থার পরেও বাংলাদেশে অবশ্য ব্যাপকতা পায়নি মি টু ক্যাম্পেইন।

সোশ্যাল মুভমেন্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ডক্টর সামিনা লুৎফা। তিনি মনে করেন এ ধরনের ক্যাম্পেইন প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেকোনো যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কথা বলার বিষয় নির্ভর করে কিভাবে সমাজে নিপীড়ণকারী এবং নিপীড়িতকে দেখা হচ্ছে তার ওপরে। যদি সমাজে যৌন নিপীড়ককে একজন অপরাধী হিসেবে দেখা না হয় এবং দেখা হয় পৌরুষত্বের অংশ হিসেবে, তাহলে দুধরনের বিষয় ঘটে। একটা হচ্ছে যৌন নিপীড়নকে চিনতে পারে না মানুষ। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে যে পরিস্থিতিতে আছেন সে অবস্থায় তিনি সেটা বলার সাহস পান না।’

‘যৌন নিপীড়ন যৌন ইচ্ছা থেকে তৈরি হয় না, এটা তৈরি হয় পুরুষের ক্ষমতার চর্চা থেকে। পুরুষ তার ক্ষমতাকে চর্চা করে অধীনস্ত নারীকে নানাভাবে হেনস্থা করার মধ্য দিয়ে।’ তার মতে, ‘ক্ষমতাশালী পুরুষের বিরুদ্ধে নারী কথা তখনই বলবে যখন সে বিচারের সম্ভাবনা জানবে। কিন্তু এ সমাজ নিপীড়িত নারীকে আরো বেশি নিপীড়ন করে।’ মেয়েরা যতই ঘর থেকে বের হচ্ছে এ ধরনের নির্যাতন কমার বদলে আরো বাড়ছে বলে মনে করছেন সামিনা লুৎফা।

এক্ষত্রে তিনি তনু হত্যার পর সৃষ্ট বিক্ষোভ প্রতিবাদ এবং পহেলা বৈশাখে যৌন হামলার পরের প্রতিবাদের উদাহরণ টানেন। যা পরবর্তীতে আর বেশি দূর যেতে পারেনি। ফলে এই ক্যাম্পেইন বিশ্বে জোয়ার তৈরি করতে পারলেও বাংলাদেশে এসে মুখথুবড়ে পড়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
যৌন হয়রানি,মি টু,ধর্ষণ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist