গাজী শাহনেওয়াজ

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৮

গলার কাঁটা ইভিএম!

নির্বাচনে ব্যবহার হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। সেই ইভিএম এখন কমিশনের গলার কাঁটা, কারণ এটি ত্রুটিপূর্ণ। প্রতিটি নির্বাচনেই ইভিএম ভোগাচ্ছে এই সাংবিধানিক সংস্থাকে। সদ্য অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের তিক্ত অভিজ্ঞতা হজম করতে হয়েছে ইসিকে। প্রতিটি কক্ষে বিলম্বে ভোটগ্রহণ, ক্ষণে ক্ষণে ত্রুটির বিড়ম্বনায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। এরপরও ইভিএমে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করছে কমিশন।

এরআগের বেশ কিছু নির্বাচনেও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল তখনকার কমিশন। সদ্য ঘোষিত ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটিতে একটি করে ওয়ার্ডে পুনরায় ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান মো. নুরুল হুদা। তবে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ইভিএম সম্ভব কি না, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ রসিকের ত্রুটি নিরসনে এখন ব্যস্ত এ সংশ্লিষ্টরা।

পাশাপাশি, ঢাকার দুই সিটির কথা উল্লেখ না করলেও নতুন ৫ সেট ইভিএম চেয়ে বাংলাদেশ মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ) চিঠি পাঠাচ্ছে ইসি। এতে স্বাক্ষর রয়েছে এনআইডির ডিজি ব্রি. জে. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের। মন্তব্য পেতে এনআইডির ডিজিকে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে, নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, রংপুর সিটিতে ইভিএমে কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি। নিরবচ্ছিন্নভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। আপনি যে ইভিএমে ত্রুটির কথা বলছেন তা গত কমিশনের সময়ে অনুুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএমের কথা। কারণ এই নির্বাচনে একটি বারের জন্য ইভিএমে কোনো বিঘœ ঘটেনি। এমনকি আপনি যে অভিযোগটি হাজির করেছেন তা ফালতু এবং ভিত্তিহীন। সচিব আরো বলেন, রংপুরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ঢাকায় দুই সিটির একটি করে ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করার মাধ্যমে ভোটগ্রহণের অভিব্যক্তি জানিয়েছেন সিইসি।

১/১১ হুদা কমিশনের ইভিএম বাতিল করা গত কমিশনের নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, রংপুরে যেহেতু ত্রুটি ধরা পড়েছে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ত্রুটিমুক্ত করে নির্বাচনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শ্রেয়। অন্যথায় কমিশন নিজেরাই বিতর্কের মুখে পড়বে।

আর স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, ইভিএমের বিপক্ষে অধিকাংশই মানুষ। সবকিছু বিবেচনা না করে এটা প্রয়োগ করতে গেলে কমিশন বিতর্কিত হয়ে পড়বে। আর ইভিএমের প্রথম উদ্ভাবক বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক লুৎফুল কবির বলেন, মনুষ্যসৃষ্ট যেকোনো যন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ। তবে, ত্রুটি নিরসনযোগ্য। এর জন্য সময়, ধৈর্য দরকার, যা কমিশনের অর্জন করতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে মত ছিল বরাবরই। এবার আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব দলে বিপরীত অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।

ইসি সূত্র জানায়, ড. শামসুল হুদা কমিশনের কেনা ইভিএম অকেজো ঘোষণা করেছে। ইসি এই কাজটির জন্য আট সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে তাদের মতামত নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের ইভিএম বাদ দিয়ে নতুন ইভিএমে আগামীতে (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ) নির্বাচন করার কথা ভাবছে ইসি।

প্রতিদিনের সংবাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় রংপুর সিটি নির্বাচন। এ সিটির ২৫ নং ওয়ার্ডের ১৪১ নং কেন্দ্রের ৬টি কক্ষে ইভিএমে ভোট হয়। এখানে মোট ভোটার ২০৬৯টির মধ্যে ১২৫০জন ভোটার ভোট দেন। যার মধ্যে মেয়র পদে ১২২৭টি, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১২২৩ ও সংরক্ষিত পদে ১২২৮টি। ৬ নং এর গোপন কক্ষে কাউন্সিলর পদের ব্যালট কিছু সময় নষ্ট ছিল। ফলে চারজন ভোটার ওই আসনের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। এ কারণে কাউন্সিলর পদে ১২২৩টি ভোট গণনা হয়। ভোটগ্রহণের আগেই ৬ নং কক্ষের ভোটার শনাক্তকরণ মেশিন চালু না হওয়ার কারণে অতিরিক্ত ভোটার শনাক্তকরণ মেশিন ব্যবহার করে ভোটার শনাক্তকরণ শুরু হয়। আর ৫ নং কক্ষে পাঁচজন ভোটার শনাক্ত করার পরই মেশিনটি বন্ধ হয়ে যায়; এখানেও অতিরিক্ত মেশিনের সহায়তায় ভোট নেওয়া হয়। আর ১ থেকে ৬ নং কক্ষের প্রতিটিতেই ভোট চলাকালে ভোটিং মেশিন অটো বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে প্রতিটি কক্ষেই ভোটগ্রহণ ১৫-২০মিনিট বিলম্বে শুরু হয়। ভোটিং মেশিন অটো বন্ধ হওয়ার কারণে ভোট প্রক্রিয়াধীন এমন ৮টি ভোট কাউন্ট হয়নি। ফলে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী কক্ষে পাঠিয়ে ভোট নেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিটি কক্ষের ভোটার শনাক্তকরণ মেশিনের ভোটিং মেশিনের কি বোর্ডের (সফট ও হার্ড) কি বোর্ডগুলো অতি সংবেদনশীল হওয়াতে পার্সওয়ার্ড প্রদান করার সময় প্রায়ই সময় কিগুলো আটকে যায়।

২০১০ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা করে। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জে, পরে নরসিংদী পৌরসভা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের পুরো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়। সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আংশিক ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ধাক্কা খায়। রাজশাহীতে টিটি কলেজ কেন্দ্রের একটি বুথে গৃহীত ৩১০টি ভোট মুছে যাওয়ায় ওই বুথের ভোট বাদ দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল হিসাব করে দু’সপ্তাহ পর ওই কেন্দ্রে সাধারণ কাউন্সিলর পদে কমিশনকে আবারও ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করতে হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে গিয়ে মরগান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইভিএম-এ ত্রুটির কারণে সেখানে ১০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। পরে নতুন মেশিন দিয়ে ভোটগ্রহণ চালু হলেও আগে কাস্ট হওয়া ১০৬টি ভোট গণনায় আসেনি। একরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৯ নম্বর বুথে মূল ভোটারের ৩৪টি কাস্টিং ভোটই হয়ে যায় ডামি। গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ১০ নম্বর বুথে দীর্ঘক্ষণ ইন-অ্যাকটিভ ছিল মেয়র পদের ভোটিং মেশিনটির কিছু বাটন। হাজী সিরাজউদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ১ নম্বর মহিলা বুথে ৫৫টি ভোটগ্রহণের পর প্রথমবার এবং ৬৪ ভোট গ্রহণের পর দ্বিতীয়বার মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। সব ভোট নষ্ট হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও নরসিংদীতেও বহু কেন্দ্রে এ ধরনের ত্রুটি দৃশ্যমান হয়েছে।

এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন স্বল্প পরিসরে ইভিএম পদ্ধতি চালু করার পর এ নিয়ে গবেষণা করতে একটি সেল গঠন করে বিএনপি। ইভিএম পদ্ধতির নানা ত্রুটির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্র দখল না করেও ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দখল করা যায়। তার নানা উদাহরণ দেশে-বিদেশে নানা নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। আমাদের দেখতে হবে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ গণতান্ত্রিক দেশে ইভিএম ও ই-ভোটিং পদ্ধতি চালু নেই। কেউ কেউ এটাকে আরো নিরাপদ করার কৌশল খুঁজছে।

ভোটারদের আস্থা, স্বচ্ছতা, বিশ্বাস ও অনিশ্চিত নিরাপত্তার কারণে এ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে নেদারল্যান্ডস। এ পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে জার্মানি। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য পার্লামেন্ট ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৬ সালে ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে আয়ারল্যান্ড। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে ভারতে। ইতালি বলেছে, ইভিএম খুব সহজে কারচুপি করা যায়। সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ বিতর্কিত এই পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন,ইভিএম,ইসি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist