রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১২ আগস্ট, ২০২০

তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক অবস্থান

করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে তাইওয়ানের সাফল্য গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে, তাই সে দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করছে অনেক দেশ। অন্যদিকে করোনার আবির্ভাব ও প্রসার রুখতে ব্যর্থতার কারণে প্রবল সমালোচনার মুখে রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। বিশেষ করে আমেরিকার লাগাতার আক্রমণের মুখে সে দেশের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যকলাপের ওপরও এই সংঘাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে বিশেষ করে আমেরিকার সমালোচনা সত্ত্বেও ইইউ এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের আশা করছে। সেক্ষেত্রে করোনা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চ এই প্রথম সর্বসম্মতিক্রমে কোনো প্রস্তাব অনুমোদিত হবে। শুধু চীন নয়, করোনা সংকটকে কেন্দ্র করে ইইউর সঙ্গেও আমেরিকার সংঘাত দেখা যাচ্ছে। টিকা আবিষ্কৃত হলে সবার আগে সেটি হাতে পেতে চায় ওয়াশিংটন।

অন্যদিকে ইইউ গোটা বিশ্বে যত দ্রুত সম্ভব সেই টিকা পৌঁছে দেওয়ার পথ খুঁজছে। ২৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত তাইওয়ানের নিজস্ব পতাকা, সংবিধান, আইনসভা, নির্বাচিত সরকার, আধুনিক সমরাস্ত্র-সমৃদ্ধ তিন লাখ সদস্যের সশস্ত্র বাহিনীসহ এর সঙ্গে রয়েছে বিশ্বের ১৪টি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের ফলে চীনের তৎকালীন শাসক চিয়াং কাইশেক তার দল-বল নিয়ে তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যান এবং তখন থেকে মূল চীনা ভূখন্ড থেকে তাইওয়ান বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে।

এমনকি চীনের পরিবর্তে এটি জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যও ছিল এবং ১৯৭৯ সালে আমেরিকার সঙ্গে চীনের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত তাইওয়ান জাতিসংঘে মূল চীনের প্রতিনিধিত্ব করে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন পরবর্তীতে চীন তাইওয়ানের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং তাইওয়ানের জাতিসংঘের সদস্যপদ খারিজ হয়। আমেরিকা তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক না রাখার অঙ্গীকার করে। তবে এখন অবধি তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নে চীন সরকার ও তাইওয়ান কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে তীব্র মতবিরোধ। মূল ভূখন্ড চীন সর্বদাই ‘এক চীন নীতি’তে বিশ্বাসী এবং এ কারণে তাইওয়ান দ্বীপকে নিজেদের ভূখন্ডের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও প্রদেশ হিসেবে দাবি করে সংবিধানে তাইওয়ানকে ‘পবিত্র ভূমি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও অধিকাংশ তাইওয়ানিরা ভিন্নমত পোষণ করে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। চীন তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখন্ডের সঙ্গে একীকরণ করতে সচেষ্ট। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে মূল সংকট এখানেই। তাইওয়ানের পূর্ববর্তী কুওমিনতাং (কেএমটি) দলের সরকার তাইওয়ানের চীনের সঙ্গে একীকরণের প্রশ্নে দ্বিমত করেনি। বেইজিং বলেছে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) এবং তৎকালীন তাইপের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কুওমিনতাংয়ের মধ্যে ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তিতে উভয় সংগঠন ‘এক চীন নীতি’র স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং প্রকারান্তরে তাইওয়ান স্বাধীনতা চাইবে না মর্মে স্বীকার করে নেয় এবং এক দেশ, দুই পদ্বতি নীতির আলোকে তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের কথাও ওই সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়।

অথচ কেএমটি এখনো সিসিপির সঙ্গে ভবিষ্যতের যেকোনো আলোচনার সূচনার ভিত্তি হিসেবে ওই চুক্তির ওপর আস্থাশীল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসা ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির অবস্থান কেএমটির সম্পূর্ণ বিপরীত। তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) নেতা সসাই ইনগ ওয়েন সিসিপি ও কেএমটির সমঝোতামূলক ঐকমত্য প্রত্যাখ্যান করে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে প্রদত্ত ভাষণে বেইজিংয়ের এক দেশ, দুই পদ্ধতি কাঠামোকে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ডিপিপি দলটি এখনো তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষেই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট। যদিও ১৯৭৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ত্যাগ করে চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীনের এক চীন নীতির স্বীকৃতি দিয়ে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও ভূখন্ড হিসেবে স্বীকার করে। তবে প্রেসিডেন্ট কার্টার তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ত্যাগ করলেও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য আমেরিকান আইনসভা বিকল্প পদক্ষেপ নেয়। কার্টারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ত্যাগের কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকান আইনসভা তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট (টিআরএ) আইন পাস করে তাইওয়ানের সঙ্গে আনঅফিশিয়াল সম্পর্ক বজায় রাখার সিদ্বান্ত নিয়েছিল এবং এই আইনের কারণেই এখন অবধি তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক বিদ্যমান আছে। এই আইনবলে তাইওয়ানের নিজ প্রতিরক্ষার জন্য তাইপের কাছে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয় এবং আমেরিকা তাইওয়ানকে চীনের আক্রমণ থেকে রক্ষার বিষয়টি অস্বীকার করেনি।

এমনকি এই আইনের ফলে আমেরিকা ঢালাওভাবে তাইওয়ানের কাছে আধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি ও রফতানি করে সমরাস্ত্র সজ্জিত করে তুলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল সময়কালে আমেরিকা তাইওয়ানের কাছে ২৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি বিক্রি করেছে। এ সময়ে আমেরিকা থেকে অস্ত্র আমদানিতে বিশ্বের যে ১০ দেশের নাম শীর্ষে রয়েছে তার মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে তাইওয়ান (সূত্র : স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট আর্মস ট্রান্সফার ডেটাবেইস)। অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি চীন কখনো সহজভাবে গ্রহণ করেনি। এ কারণে চীন-আমেরিকার মধ্যে যেমন উত্তেজনা আছে, তেমনি অত্রাঞ্চলের সমুদ্রসীমা জুড়ে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কাও সর্বদাই বিদ্যমান।

এদিকে, তাইওয়ান তার প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে চলেছে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এর প্রতিরক্ষা বাজেট বরাদ্দ ছিল ১১.৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট জিডিপির ২.১৩ শতাংশ। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে আরো ২.৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে দেশের সরকার। অ্যাডভান্সড ওয়েপন্স সিস্টেম ট্রেনিং এবং নতুন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তথা মিসাইল, ইলেকট্রনিকস ওয়ারফেয়ার টেকনোলজি ও মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমস ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত এই অর্থ ব্যয় করার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে সমৃদ্ধ হয়ে তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার ইচ্ছা পোষণ করে চলেছে। এতে রয়েছে আমেরিকার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সমর্থন। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো রাখঢাক না করেই তাইওয়ানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে ট্রাম্প চীনের আপত্তি উপেক্ষা করে তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপ করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

আর এ কারণে তাইওয়ানে চীনের সার্বভৌমত্বের দাবির সঙ্গে চীন আপস করবে না, বরং চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের একীকরণের জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে কার্পণ্য করবে না—এমনটাই বলছে চীন সরকার। কারণ, ‘তাইওয়ান-চীনের এই নীতিতে বিশ্বাসী চীন। চীনা কর্তৃপক্ষ মনে করে, তাইওয়ান যদি এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তবে সেটি হবে বিপজ্জনক, যা চীনের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, বিশেষ করে তিব্বত, হংকং, ম্যাকাও এবং জিনজিয়াংয়ের মুসলিমদের স্বাধীনতায় উৎসাহিত করবে এবং এভাবে চীনের ঐক্য, ভূখন্ডগত সংহতি ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে। বিশ্বব্যবস্থায় চীনের বৃহৎ শক্তিসূলভ মর্যাদা ও দম্ভ চূর্ণবিচূর্ণ হবে। একীকরণের সংস্কৃতি বেশির ভাগ চীনা জনগণের কাছে অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস, তাইওয়ান যদি সরকারিভাবে মূল ভূখন্ড চীন থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং আইনত একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়, তার প্রভাব চীনা জনগণকে তাদের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করবে ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। ফলে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হ্রাস পাবে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কাজেই চীন তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতা কখনো গ্রহণ করবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভূখন্ডের সংহতি রক্ষা করা চীনের মৌলিক নীতি। এই নীতি থেকে এক চুলও নড়বে না চীন, এমনটিই বলছে কর্তৃপক্ষ। তবে শান্তিপূর্ণ পথে একীকরণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে চীন, তা না হলে শক্তি প্রয়োগের পথেই হাঁটবে। তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার রয়েছে একাধিক স্বার্থের সম্পর্ক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—তাইওয়ানের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান।

এ ছাড়া তাইওয়ানের ভূখন্ড আমেরিকার সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক। এখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারবে। চীনকে মোকাবিলার জন্য, এশিয়ায় আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার জন্য তাইপেতে আমেরিকার উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান রোধ করা। এজন্য চীনের প্রায় বুকের ওপরে থাকা তাইওয়ানে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি চীনকে রোধ করার একটি কার্যকর উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এসব লক্ষ্য থেকেই আমেরিকা তাইপের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনেও আগ্রহী আমেরিকা। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে মৌলিক প্রশ্নে বিরোধ, অন্যদিকে তৃতীয়পক্ষ আমেরিকার তাইওয়ানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ, সবমিলিয়ে ওই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

এদিকে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের পক্ষ থেকে জানা যায়, চিফ অব জয়েন্ট স্টাফ ডিপার্মেন্ট এবং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের সদস্য জেনারেল লি ঝুছেং জানিয়েছেন, সেনাদের প্রয়োগের সব পথ উন্মুক্ত রয়েছে এবং চীন তাইওয়ানের ওপর হামলা করা হবে। ২০০৫ সালের আইন অনুসারে তাইওয়ানের ওপর হামলা চালানোর অনুমতি পেয়েছিল চীন সরকার। তাইওয়ান যদি চীন থেকে বেরিয়ে যেতে চায় অথবা চীনের বিরোধিতা করে তাহলে তাদের ওপর মিলিটারি আক্রমণ করার সম্মতিপ্রাপ্ত হয় চীন। প্রথম থেকেই হামলার কথা বলে আসা চীন থেকে এই প্রথমবার সেনাবাহিনীর কোনো শীর্ষস্থানীয় প্রধান এ বিষয়ে সরাসরি হামলার বিষয়ে জানালেন। তাইওয়ান চীনের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, উপলব্ধি করতে পেরে চীন সরকার এমনটা ঘোষণা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তাইওয়ান,চীন,করোনাভাইরাস,কূটনৈতিক সম্পর্ক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close