শ্যামা সরকার

  ০১ জুলাই, ২০২০

সংকটের মুখে পোশাকশিল্প

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। সংক্রমণ যতো বাড়ছে, আমাদের অর্থনীতিতে ঘণীভূত হচ্ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বিশেষ করে, পোশাকশিল্প এরই মধ্যে সংকটের মুখে পড়েছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর করে এ খাতটি টিকে আছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্ডার সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।

ষাটের দশক থেকে আমাদের দেশে তৈরি পোশাকশিল্পের যাত্রা। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। ষাটের দশকে ব্যক্তি উদ্যোগে ক্রেতাদের সরবরাহকৃত এবং তাদেরই নির্দেশিত নকশা অনুযায়ী স্থানীয় দর্জিরা পোশাক তৈরি করতেন। অভ্যন্তরীণ বাজারগুলোতে শিশুদের পোশাক এবং পুরুষদের গেঞ্জি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না বললেই চলে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এর ফলে তৈরি পোশাকশিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের আয় বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রায় অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। সেই থেকে এ খাতটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জিডিপিতে (গ্রস ডমেসটিক প্রোডাক্ট) উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।

তবে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এ শিল্পে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মূলত চীন থেকেই এ ভাইরাসের প্রভাব, যা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ঙ্কর এ ভাইরাস সংক্রমণের ফলে চীনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে গোটা বিশ্ব। এর ফলে ধস নেমেছে দেশটির পর্যটন শিল্পে; বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পণ্য লেনদেন। এছাড়া, চীনা নাগরিকদেরও অন্য দেশে প্রবেশে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে আমাদের পোশাকশিল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কারণ আমাদের দেশে পোশাক খাতে যে কাঁচামাল আসে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়। নিটওয়্যার খাতেও এ দেশ থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে। কাপড়, পলি, জিপার, কার্টন, লেস, হ্যাঙার, বোতাম, রঙ ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং বিভিন্ন এক্সেসরিজের জন্য আমরা দেশটির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া, চীনের জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহ ক্ষেত্র উহান শহর থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রমাগত দর হারাচ্ছে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব শেয়ারবাজারেও। ব্যাহত হচ্ছে দেশের বাইরে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। কমছে শিল্প খাতের কার্যক্রম ও খুচরা বিক্রি। চীনের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সীমিত আকারে কারখানা চালু করা হয়েছে। এ কারণে পোশাক শ্রমিকরা অনেকটাই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করা তাদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বৈশি^ক এ মহামারীতে তারা কঠিন সময় পার করছেন। তাদের তেমন কোন সঞ্চয় নেই, যা দিয়ে তারা এ সংকটময় মুহূর্ত পার করবেন। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের কাজে ফিরতে হচ্ছে। স্বস্তির কথা হলো- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে পোশাকশিল্পের কর্মীদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বা বিজিএমইএ’র সভাপতির কাছ থেকেও শ্রমিকদের বেতনভাতা অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

বৈশ্বিক এ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়বে। পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশও ঝুঁকির মুখে। এর ফলে পোশাক শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অনেকেই হতে পারেন কর্মহীন।

বাংলাদেশ এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ বিষয়টি প্রতিনিয়তই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। স্থবির হয়ে পড়বে অর্থনীতির চাকা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে পোশাকশিল্প থেকে। এমন পরিস্থিতিতে সংকট আরো গভীর হওয়ার আশঙ্কা করছেন পোশাক মালিকরা। এছাড়া, এ সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে বলেও মনে করেন তারা।

বিজিএমইএ'র তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৪ হাজার ৫৬০টি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত অর্থবছরে এ শিল্প থেকে রপ্তানি আয় ছিল ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে।

এতে সন্দেহ নেই যে, করোনাভাইরাস আমাদের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমাদের পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে হলে এখন থেকেই বিকল্প চিন্তা করতে হবে। শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কাঁচামালের নতুন বাজার খুঁজতে হবে। দেশীয় ব্যবস্থাপনায় কাঁচামাল উৎপাদনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায় দেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এ সংকট মোকাবেলায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই সচল হবে অর্থনীতির চাকা।

লেখক : ম্যানেজার (কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) প্রধান কার্যালয়, উদ্দীপন

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পোশাকশিল্প,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close