রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ জুন, ২০২০

সমাজ, সময় এবং মানুষের লড়াই

পৃথিবীজুড়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো হাঁটছে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই। বিশ্বের বড় বড় দেশ অর্থনীতি বাঁচাতে জারি হওয়া লকডাউন শিথিল করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাসের হুমকি বিশ্বের ঘাড়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান থাকবে। দ্বিমুখী এই সংকট মোকাবিলায় জীবন ও জীবিকার যুদ্ধে নেমেছে বাংলাদেশও। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস, শেয়ারবাজার, ব্যাংক-বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আদালত, দোকানপাট শপিংমল, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু সীমিত আকারে চলছে। প্রতিটি স্তরের কার্যক্রমে মানতে হবে সরকার নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধি। সরকারি-বেসরকারি অফিসের জন্য যেমন দেওয়া হয়েছে ১৮ দফা গাইডলাইন, তেমনি গণপরিবহনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চালু করতেও মানতে হবে শর্ত।

এদিকে ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে সব খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা দুনিয়ার মানুষকে মৃত্যু ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বলতে গেলে বিদায়ী বছরের শেষে অদৃশ্য এক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের অনেকেই। মৃত্যুও হয়েছে অনেক এবং এখনো হচ্ছে। আবার সেরেও উঠেছেন অনেকেই। তবুও এ আতংক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দুনিয়ার মানুষকে। এমনকি উন্নত বিশ্বের মাতব্বর ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এরই মধ্যে দেশটির লক্ষাধিক মানুষকে এ রোগে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

উল্লেখ্য, তুলনামূলক অনেক পরে অর্থাৎ ৮ মার্চ বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। মূলত এ রোগটি সংক্রমিত হয়েই একে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শুরুতে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনের মতো শব্দগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহন, বিমান, নৌযান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, এমনকি আদালত পর্যন্ত। দেশজুড়ে চলে সচেতনতা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার লড়াই। সংক্রমণের আতঙ্কে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ অতিস্বজনরাও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সেবাযত্ন থেকে দূরে থাকছেন। আর কেউ মৃত্যুবরণ করলে স্পর্শ করা তো দূরের কথা সৎকারেও কেউ এগিয়ে আসেন না। কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী দাফন করা হচ্ছে। এ এক অমানবিক বিশ্ব আমাদের দেখতে হচ্ছে। যেখানে একমাত্র ভরসা সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স ও আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিতরাই। বিশেষ করে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনের শাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি মৃতদেহ সৎকার ও ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে তৎপর থাকা পুলিশ বাহিনী এরই মধ্যে দেশের মানুষের কাছে ‘মানবিক পুলিশে’ পরিণত হয়েছে। অথচ এই পুলিশের ব্যাপারে এ দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। আজ কিন্তু সে সবই অতীত। যা আজ ম্লান হয়ে গেছে পুলিশের মানবিক আচার আচরণে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মীসহ, পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্য।

এরই মধ্যে আক্রান্ত পুলিশের অনেকেই এবং গণমাধ্যম কর্মীদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। এ রোগে আক্রান্ত হওয়া অনেক পুলিশ সদস্যের ফেসবুকে দেওয়া মর্মস্পর্শী স্টাটাস পড়তে যেন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। শুধু কি তাই। প্রতিদিন কত অমানবিক ঘটনার খবর পড়তে হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। দেখা গেছে, অনেক সময়ই ইউএনও, চিকিৎসক, পুলিশ ও র‌্যাবকেই জানাজা পড়িয়ে মৃতের সৎকার করতে হচ্ছে। ফলে তারা আক্রান্তও হচ্ছেন এবং মারাও যাচ্ছেন। আবার অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসছেন নিজ নিজ দায়িত্বে। বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য যুগে কী এক নিদারুণ অমানবিক বিশ্বকে এখন দেখছি আমরা। এখন অনিশ্চিত শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কোন ভ্যাক্সিন কিংবা কার্যকরী ওষুধ এখনো ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। বাংলাদেশ কেন, গোটা বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ দেশগুলোও এই ভাইরাসের আক্রমণ মোকাবিলায় অনেকটাই অসহায়। এক সময় ইতালির সরকার প্রধান হতাশা ব্যক্ত করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকাকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আহাজারি করলেন। বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস করোনা মোকাবিলার ভ্যাক্সিন কিম্বা ওষুধ উদ্ভাবনে যত টাকাই লাগুক সে সহায়তার ঘোষণা দিলেও এখনো সফলতার দেখা মেলেনি। যদিও এরই মধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপানসহ অনেক দেশই করোনা মোকাবিলার ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের দাবি করেছেন। কিন্তু সে সবগুলোই এখনো ট্রায়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আশার কথা, এরই মধ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় রেমিডিসিন নামক ওষুধ প্রস্তুত করে তা বিপণন করাও শুরু হয়েছে। এর কার্যকারিতা কতটুকু তা হয়ত সময়েই বলে দেবে।

করোনা সংক্রমণে গোটা বিশ্বটাই স্থবির হয়ে গেছে। রুটি, রুজি, জীবন-জীবিকা মুখ থুবরে পড়েছে। কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। কোথাও কোথাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক। মনে হয় এই বুঝি মৃত্যু দূত এসে হাজির হয়। কাজকর্ম হারিয়ে সাধারণ মানুষকে সাহায্য নির্ভর হয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে লাখ লাখ মানুষকে কাজ হারাতে হয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলোর মৃত্যু হারও ধীরে ধীরে কমিয়ে আসছে। ফলে তারা লকডাউন শিথিল করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা একেবারেই উল্টো। যখন বিশ্বের কোন কোন দেশে আক্রান্তের ও মৃত্যু হার কমে আসছে, তখন বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এমন মুহূর্তে সরকার লকডাউন শিথিল করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অফিস, আদালত চালুর পাশাপাশি সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ব্যবস্থা করেছে। হয়তো এখন জীবিকার তাগিদেই সরকার শর্তসাপেক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতেই চায় না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরন্তর প্রচেষ্টারও যেন শেষ নেই। তবুও মানুষ নানা অজুহাতে চলাফেরা করছেই। স্বাস্থ্যবিধি বলতে মুখে মাস্ক ব্যবহার, জনে জনে তিন ফুট দূরত্ব রক্ষা, ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, যা প্রতিপালন করা কঠিন কিছু নয়। অতি সহজ এই কাজগুলোই আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ করতে চায় না। হাতে গোনা কিছু মানুষ ছাড়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মুখে কোনো মাস্ক নেই। শারীরিক দূরত্বতো একেবারেই নেই। গা ঘেঁষে গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দিচ্ছে। শুধু প্রয়োজনের তাগিদে যারা ঘরের বাইরে এসে বাজারে কেনা কাটা করছেন কিম্বা রিকশা, ভ্যান চালাচ্ছেন তাদেরই কেউ কেউ মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন।

এই যখন অবস্থা, তখন সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস, ট্রেন, লঞ্চে মানুষ যাতায়াত করবেন, এমন আশা করা সত্যিই কঠিন! যা প্রতিনিয়তই ঢাকা থেকে আসা যাওয়া মানুষের গাদাগাদির জনস্রোতের চিত্র দেশের মানুষ দেখছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আবারো হয়তো জীবনের প্রশ্নে কঠোর সিদ্ধান্তের পথেই সরকারকে হাঁটতে হতে পারে। শুরু থেকেই সরকার দেশের সাধারণ ও ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য সহায়তার আওতায় কম মূল্যে চাল বিক্রির পাশাপাশি বিনামূল্যে চাল সরবরাহ করা সহ নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েই চলছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন, বিত্তবান এবং পুলিশ বাহিনীর তরফেও নানাভাবে খাদ্য, অর্থ, চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরাও করোনা আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছেন। জীবিকার তাগিদে যেমন সবকিছু শিথিল করা হচ্ছে, তেমন জীবন বাঁচানোর জন্যও চিকিৎসার সুযোগকে যেকোনো মূল্যেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ করোনার ভয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ও স্বাভাবিক যেকোনো চিকিৎসাসেবা থেকে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ স্বাভাবিক চিকিৎসার নিশ্চয়তাটুকু মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী লোক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁরাই দিন আনে দিন খায় মানুষ। দেশের মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে ৫ কোটির বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। অন্যরা আনুষ্ঠানিক খাতের কাতারে। অথচ করোনায় তাদের জীবিকাও হুমকিতে আছে।

এছাড়া গত দুই সপ্তাহের হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে একদিনে রেকর্ড ১ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও বিশ্বের অনেক দেশ লকডাউন তুলে নিচ্ছে। তাদের সতর্ক করে দিলেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম ঘেব্রেইয়েসাস। এখনই লড়াই না থামানোর আহ্বান জানালেন তিনি। তেদ্রোস বলেছেন, এই মহামারি ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলছে, এখনই কোনো দেশকে লড়াই থেকে গুটিয়ে যাওয়া যাবে না। তিনি যোগ করেছেন, বিজ্ঞান, সমাধানের উপায় ও সংহতির ভিত্তিতে দেশগুলো কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান জানান, আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ১০টি দেশ থেকে বেশি আক্রান্তের খবর পাচ্ছেন। তেদ্রোস বলেছেন, ইউরোপে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বৈশ্বিকভাবে এটি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিছু দেশে ইতিবাচক আভাস পাওয়া গেলেও তাদের আত্মতৃপ্তিতে ভোগার ব্যাপারে সতর্ক করলেন তেদ্রোস, ‘আফ্রিকান অঞ্চলে এখনো কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, যদিও অধিকাংশ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজারের নিচে। তাছাড়া পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনাভাইরাসের ছোবলের মধ্যে এভাবে সব খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমনকি উদ্বিগ্ন খোদ দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি। আপত্তি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাস অতি সংক্রামক হওয়ায় এই রোগ প্রতিরোধের বিধিবিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ ছাড়া লকডাউন শিথিল করা হলে রোগ সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনাভাইরাস,সমাজ,সময়,মানুষ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close