আদিল মাহমুদ

  ২৩ মে, ২০২০

বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা এবং করোনাভাইরাস

মানবজাতি মহান সৃষ্টিকর্তার এক মহাসৃষ্টি; আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ মানুষের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক ও চিন্তা-চেতনা দিয়েছেন, যাতে ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ বুঝে চলতে পারে এবং অপকর্মের পরিণতি উপলব্ধি করতে পারে।

মানুষকে শিখিয়েছেন অনিষ্ট, অকল্যাণ, মন্দকাজ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার কৌশল। মুক্ত জ্ঞান এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়ে মানুষকে সমগ্র সৃষ্টির ওপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। মানুষের কল্যাণেই তিনি সৌরজগৎ ও মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর জন্য মানুষ নয় কিন্তু, মানুষের জন্যই পৃথিবী। তাই, যদি পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন সম্ভব হয় তা শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্যই হয়, অকল্যাণে নয়।

কিন্তু পৃথিবীর মাটি ও বায়ুমণ্ডলের যে পরিবর্তন আমরা দেখছি তার সবই মানুষের তৈরি। ওজন স্তর কমে যাচ্ছে, ফুটো হচ্ছে, বায়ুদূষণ হচ্ছে, জলাভূমি ধংস করে আবাসন, খাল-নদী ভরাট করে নানা স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশকে নষ্ট করা হচ্ছে। আর এসব ডেকে আনছে অকল্যাণ। আবার বিজ্ঞান ও প্রযক্তির বিকাশ এবং আবিষ্কার জীবনকে করছে সুন্দর ও আরামদায়ক। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অগাধ জ্ঞান দিয়েছেন। এই জ্ঞান ধরে মানুষ যদি কল্যাণের পথে হাঁটত তবে আরো উন্নত পৃথিবীর বাসিন্দা কি আমরা হতে পারতাম না!

আজ যে পৃথিবীজুড়ে এত ঘরবাড়ি, এত রাস্তাঘাট, এত যানবাহন, এত যন্ত্রপাতি, এত অস্ত্রশস্ত্র-এসব কিসের জন্য? আমরা দেখেছি, নাইন ইলেভেনে নিয়ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সংঘটিত হামলার ঘটনা আমাদের মধ্যে এক নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এই ঘটনা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের ঘরের চৌকাঠে যে মৃত্যু পৌঁছাতে পারে যে কোনো মুহূর্তে, সেই কথাটা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। মৃত্যু যে এক তুড়িতে জীবনকে হারিয়ে দেয়, সেই চরম সত্যটা আজ আমাদের আবার জানিয়ে দিতে এসেছে নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।

উহানের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল বলে দাবি করেছিল চীন। সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জীববিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের দাবি, করোনাভাইরাস উহানের হুয়ানান সাউথ চায়না সিফুড মার্কেটের প্রাণী থেকে নয়, ওই বাজারেরই একজন মানুষ থেকে ছড়িয়েছে।

গবেষণায় তারা দেখে বিস্মিত হয়েছেন যে, ভাইরাসটি আগেই মানুষের শরীওে ছিল। বেইজিং ভাইরাসের উৎস খুঁঁজতে যখন মরিয়া, তখন জীববিজ্ঞানীরা এমন বিস্ফোরক দাবি করলেন। অবাক হওয়ার কথা ভাইরাসটি আগের ভাইরাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। মহামারির পরবর্তী পর্যায়ে ভাইরাসটি ‘মানব সংক্রমণের জন্য বেশ কয়েকটি সুবিধাজনক অভিযোজন গড়ে তুলেছিল। গত ডিসেম্বরে উহানের একজন রোগীর কাছ থেকে নেওয়া নমুনা থেকে এটি স্পষ্ট হয়।

সবাই জানে মানুষ সভ্যজাতি, আসলে কি তাই, সত্যিই কি মানুষ সভ্য জাতি! বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কি সভ্যতার বিন্দুমাত্র লেশ পাওয়া যায়? আমি যদি আমার নিজের ঘরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলি, তবে কি আমার ছেলে-মেয়েরা বাঁচবে? পৃথিবীতো সব মানুষেরই ঘর। তাহলে কেন আমরা এমন করছি ?

এখানে বলা দরকার, বিজ্ঞান ভাতের থালা নয় যে তার কিছুটা নেব আর বাকিটা ফেলে দেব। বিজ্ঞানের তথ্য কাটছাঁট করে নিতে গেলে হদিশ মেলে না, বরং তা ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান বহু সময় এমন কিছু তথ্য এনে দেয় যা স্পর্শকাতর, এমনকি উদ্বেগজনক। এর কারণ, তথ্য তুলে আনার সময় বিজ্ঞান বাইরের প্রভাব-যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে ‘এক্সটার্নালিটি’-তার থেকে সাধারণভাবে মুক্ত থাকে। করোনার আবহে আমাদের প্রত্যেকের জীবনটাই নানাভাবে বদলে গেছে। বন্দিদশা আর বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিচ্ছে সুরক্ষাহীনতার অনুভূতির।

আসলে আমাদের বিজ্ঞান শুধু পৃথিবীকেন্দ্রিক। পৃথিবীতে কিভাবে আধিপত্য বিস্তার করা যায় তা নিয়েই হাজার বছর ধরে গবেষণা চলছে। এতে কোটি কোটি মানুষও মারা গেছে এবং এখনো যাচ্ছে, সমাধান কোথায়? আমরা মহাবিশ্বে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে তার কতটুকু জানি? আমার যে কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হতে পারে-তা কি কেউ বলতে পারে, না পেরেছে কখনো? তাহলে এই বিজ্ঞান নিয়ে কিসের এতো অহংকার!

একমাত্র মানুষই প্রকৃতির প্রতিপক্ষ। অনাদিকাল ধরে এই যে উদারপ্রকৃতি জগৎ-সংসারকে লালন করে আসছে, তার বিনিময়ে সে তো কোনো প্রতিদান চায়নি। রাবীন্দ্রিক ভাষায় সে যেন বলে আসছে, ‘তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান।’ শুধু চেয়েছে নিজের বিন্যাস সমুন্নত রেখে সৃষ্টিজগতকে সন্তান স্নেহে ধারণ করে রাখতে। মনে হয় মানুষ নামের প্রজাতিকে প্রকৃতি সন্তানাধিক স্নেহে বক্ষে আগলে রাখতে চেয়েছে নিরন্তর। কিন্তু মানুষ তার মূল্য দেয়নি।

প্রকৃতি সর্বংসহা বলে মানবসৃষ্ট প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ডকে বহন করে এসেছে। তবে স্মর্তব্য, সহ্যের একটা সীমা আছে। তা লঙ্ঘিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধ ভেঙে যায়। সমাজ-ধর্মের ইতিহাসে ‘মহাপ্লাবন’ থেকে শুরু করে যুগে যুগে মানুষ রুদ্র প্রকৃতির যত রূপ প্রত্যক্ষ করেছে তার মূলে রয়েছে কৃতঘ্ন মানুষের স্বকৃত অপকর্ম।

একুশ শতকের সূচনা থেকে লক্ষ করা গেছে, কতিপয় বিবেকবান মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখার জন্য আন্দোলন করে আসছেন। এই কল্যাণ সাধনের মিছিলে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা অনন্য। শক্তিদম্ভে কয়েকজন ব্যক্তি শান্তিপ্রিয় মানুষের সুসপরামর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। বোঝেনি প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে তারা খড়কুটোও নয়। প্রকৃতি গোঁয়ারদের দাপটের এমন জবাব দেওয়া শুর” করেছে যে সৌরমণ্ডলের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহটি তার শ্যামলিমা হারিয়ে মাটির কাছাকাছি মানব প্রজাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। দাম্ভিক মানুষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে পরস্পরের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুঁড়ি শুরু করেছে। বড়ত্ব নিয়ে হাস্যকর বড়াই শুরু করেছে। আসলে এসব প্রলাপ এক ধরনের হীনম্মন্যতা! মানব মনের সাধারণ প্রবণতা হলো নিজেকে সেরা ভাবা। অন্যরা তার কাছে নস্যি। এর চেয়ে মূঢ়তা আর কী হতে পারে?

উমাইয়া যুগের আরবি সাহিত্যের একটি লেখায় উঠেছিল-কোনো সংকট দেখা দিলে স্বার্থের বিভেদ ভুলে গিয়ে হিংস্র প্রাণিকুল এক হয়। ফলে শক্ত আগ্রাসীকেও প্রতিহত করে। আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা, পারব না কেন? বর্তমান বিশ্বে এক এক দেশের বিজ্ঞানী এক একভাবে জ্ঞান চর্চা করছেন। ফলে, বড় ধরনের অগ্রযাত্রা ব্যহত হচ্ছে। একদিক দিয়ে নাসা গবেষণা করছে, অন্যদিকে ইসরো গবেষণা করছে। রাশিয়া, চীন, ইউরোপ আরো অনেকে আলাদাভাবেই বিজ্ঞানচর্চা করছে। ফলে কেউ ডেকে আনছে ধংস, কেউ সৃষ্টি।

এদিকে, পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষা থাকায় এক দেশের মানুষের ভাষা অন্য দেশের মানুষ বুঝতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ যদি এক ভাষাভাষী হতো তবে কত না মধুর হতো! মানব জাতি নিজেরাই যুগ যুগ ধরে খুনোখুনিতে ব্যস্ত, তারা এসব জানবে কি করে? উইপোকা যেমন আগুন দেখে ঝাপিয়ে পড়ে এবং মরে, মানুষও তেমনি রক্ত দেখে ঝাপিয়ে পরে এবং মরে, এই জন্য দায়ী কে? দায়ী হচ্ছে ঘুরে-ফিরে আসা আমাদের অসচেতনতা।

করোনায় সারা বিশ্ব অথৈ সংকটে। শুধু করোনা আগ্রাসনে নয়, কর্মহীন-অন্নহীন মানুষ সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের কারণে মৃত্যু বিভীষিকার শিকার হতে চলেছে। অথচ বিজ্ঞান কি এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মুহূর্তের মধ্যেই সরাতে বা এর মূল উৎপাটন করতে পেরেছে ? পারেনি। তাই এই সময়ে সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি নয় কী? উপনিষদের ঋষিদের আর কোরআনের বাণী সমুন্নত রেখে আমরা এক হই। সমস্বরে উচ্চারণ করি, সংকট তফাত যাক; শস্যশ্যামলা ফিরে আসুক। আমরা গেয়ে যাই ‘আনন্দধারা বহিছে ভূবনে’।

পরিশেষে বলতে চাই বিজ্ঞানের কারণে যত কল্যাণ এ পর্যন্ত হয়েছে তা অকল্যাণের কাছে অতি সামান্যই। তার কারণ একটাই নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা। যেমন প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মিশরের পিরামিড কীভাবে তৈরি হয়েছে, কে তৈরি করেছে তা এখনো মানুষের অজানা। যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই পিরামিড তৈরি হয়েছিল তা যে বর্তমান বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায়ও সম্ভব নয়। আমরা মানুষ, অতি উন্নত জাতি। পৃথিবীতে এমন আশ্চর্যজনক বিশাল স্থাপনা তৈরি হবে অথচ তার কিছুই আমরা জানতে পারবো না-এ কেমন ‘বিশেষ জ্ঞান’!

লেখক : পরিদর্শক (তদন্ত) পরশুরাম থানা, ফেনী

Email : [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনাভাইরাস,বিজ্ঞান,বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close