১১ মার্চ, ২০২০

বাঙালির দুই নম্বরি চিন্তা

প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কতটা অসহায় তা যেন আবারও প্রমাণিত হলো। মানুষের জিদ আর অহংকার যে মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে খোদ প্রকৃতির কাছেই তা বুঝতে না পারাটা নেহায়েৎ বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজ্ঞান একসময় বলত- শুধুমাত্র মানুষের প্রাণটা আবিস্কার করাই নাকি বাকি। এছাড়া এমন কোনো কাজ নেই যা মানুষ পারে না। মানুষ আসলেই সব পারে।

একদিন হয়তো বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর রুপে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাসের টিকাও আবিস্কার করবে। কিন্তু তার আগে? গবেষকরা ঘোষণা দিয়েছে এরইমধ্যে- করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুত হতে আরও একবছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু ততদিনে এই ভাইরাস কতটা মহামারি রূপ ধারণ করে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন। এর প্রকোপ কবে নাগাদ কমবে তা বলতে পারেন স্রষ্টা।

করোনাভাইরাস হলেই যে মানুষ মারা যায় এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই ইতোমধ্যে জানিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকিটাই মারাত্মক। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। বিশ্বের ১১১ টি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাসের প্রকোপ। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১৯ হাজার ২১৭ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৪ হাজার ২৯৯ জন। অপরদিকে করোনায় আক্রান্ত ৬৬ হাজার ৫৬৩ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের আক্রান্ত আর মৃতের খবর জানাতে ব্যস্ত সব মিডিয়াকর্মীরা। এমতাবস্থায় গত ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে চলছিল মিডিয়াম ভলিয়মে মাতামাতি। কিন্তু বিকেলে হঠাৎ আইইডিসিআর থেকে ঘোষণা এলো বাংলাদেশে ৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ব্যস শুরু হয়ে গেলো শোরগোল। আমরা মিডিয়াকর্মীরাও নিজের দেশের প্রতি নজরদারিটা বাড়ালাম।

মানুষের মধ্যে ঢুকে গেলো আতঙ্ক। কিন্তু আতঙ্ককে পাশ কাটিয়ে শয়তানিটাই যেন বেশি ঢুকে গেলো অনেকের মনে। বাঙালি তো। বাঙালির দুই নম্বরি চিন্তা নাকি প্রকট, এ কথা হরহামেশাই শোনা যায়। এটা আবারও প্রমাণ হলো।

যেখানে আত্মমানবতা জেগে উঠার কথা সেখানে দমকা হাওয়ার মতো ধূলিস্মাৎ হয়ে গেলো সেই মানবতা। মানুষরুপী কিছু পশু করোনাভাইরাস আতঙ্ককে পুঁজি করে লোভ-লালসার হাত বাড়িয়ে দিল। মানবতার হাত সেখানে মলিন। সচেতনতা বৃদ্ধির চেয়ে দুর্ভাবনায় ভরে উঠল সাধারণ মানুষের মন। ৮ মার্চ সন্ধ্যা থেকে করোনাভাইরাসের জীবাণুর হাত থেকে বাঁচতে মানুষ ছুটল ফার্মেসি এবং মুদি দোকানগুলোর দিকে। উদ্দেশ্য মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংগ্রহ। কিন্তু ব্যবসায়রুপী পশুগুলো সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দিল দাম। কয়েকদিন আগেও যে মাস্ক ২০ টাকা দাম বললে মানুষ দশ টাকা দিয়ে কেনার জন্য মুলামুলি করেছে সেই মাস্কের দাম হয়ে গেলো লাফ মেরে ২০০টাকা। মানুষের মনে তখন আতঙ্ক। ২০০ টাকাও সই। নিতে হবে। হলোও তাই। আর কিছু পশু ভবিষ্যৎ সুবিধা আদায়ের উদ্দেশে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার গোদামজাত করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ এবং লবণ কাহিনি ভুলে যায়নি এ দেশের সাধারণ মানুষ। তারই যেন পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে পরদিনই হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে তাই মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ইতোমধ্যে অনেক ফার্মেসি সিলগালাসহ বেশকিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। এইসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সোচ্চার। অনেককে মন্তব্য করতে শোনা যায়- কাফনের কাপড়ের দামও নাকি বাড়াবে এইসব মনমানসিকতার ব্যবসায়ীরা। মানবতা আজ বিলীন।

করোনাভাইরাসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ কিন্তু বাংলাদেশ। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু সরকার থেকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশ প্রস্তুত। যেখানে উন্নত বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের এই গরীব দেশ! তারপরও আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। এখন অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে- আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। কেউ কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য বলছেন। কারণ, নামাজের জন্য দৈনিক ৫ বার ওজু করতে হবে। এটা ভালো দিক। মানুষ যদি আল্লাহকে ভয় পেয়ে নামাজী হয় তাহলে মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষও আল্লাহর দরবারে করুণার পাত্র হয়ে উঠতে পারবে।

এখন কথা হচ্ছে দেশে করোনাভাইরাস ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত? ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে এখানে করোনার প্রকোপ আদৌ কি ঠেকানো সম্ভব? বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন জনসমাগমে না যেতে। শুধুমাত্র এই একটি বিষয় নিয়ে যদি বলতে চাই তাহলে কোনটা রেখে কোনটা বলব। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছেন। ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। বাস, ট্রেন, লঞ্চ কোথায় নেই গাদাগাদি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে যাবেন? ওখানেও ভিড়। স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করার কথা বলা হচ্ছে। এটা হলে ভালো হয়। কারণ প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ঘর থেকে বের হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে যাত্রা করছে। তাদের সঙ্গে আছে সমপরিমাণ অভিভাবকও। আর তাদের বহনের জন্য পরিবহন। গ্যাদারিং তো এখানেই বেশি।

প্রকৃতির এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে মানবতার হাত বাড়াতে হবে। কিছু টাকা খরচ হয় তো হোক। এটা মানবসেবা। ইসলামে তো বলা আছে মানবসেবাই পরমধর্ম। এটা করার সুযোগ কয়জনের হয়। প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীকে বিনামূল্যে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইাজার বিতরণ করা হোক। পাশাপাশি সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করা হোক। সবাইকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য করা হোক। গার্মেন্টস মালিকদের নমণীয় হতে হবে। তাদের উচিত হবে সব কর্মীকে বিনামূল্যে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবারহের পাশাপাশি তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যও তা সরবরাহ করতে হবে। এভাবেই সব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের তাদের কর্মীদের প্রতি সদয় দৃষ্টি দিতে হবে। এটাই মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হবে। যারা বিত্তশালী তারা মনে রাখবেন, আপনাদের অর্জিত কিছু সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করুন মানব সেবায়।

এরপর আসেন বস্তি এলাকায়। ওখানে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা। এইসব মানুষদের প্রতি দৃষ্টি দেয়া বেশি জরুরি। একমাত্র আল্লাহ যদি সহায় হন তাহলেই এইসব ভাসমান মানুষদের রক্ষা হবে।

সরকারের যত পদক্ষেপ নেয়ার তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইন এর ব্যবস্থা করা। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এরইমধ্যে এগিয়ে এসেছে এটা আশাব্যাঞ্জক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই সচেতনামূলক পোস্ট শেয়ার দিচ্ছেন, এ থেকেও অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সতর্ক হচ্ছেন। এরইমধ্যে বেশিরভাগ মানুষ এই ভাইরাস সস্পর্কে জেনে গেছেন। কিন্তু এই থেকে মুক্ত থাকতে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার তা জানাতে এগিয়ে আসতে হবে আপনি-আমি-সবাইকেই। দেশের সব বিমানবন্দরসহ সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। যারা দেশে প্রবেশ করছে তাদের সঠিক থার্মাল মেশিন দিয়ে চেক করতে হবে। অন্যথায় দুই ইতালী প্রবাসী যে রোগের উপসর্গ নিয়ে দেশে ইন করেছে যদি সঠিকভাবে তাদের শনাক্ত করা যেতো তাহলে তার সঙ্গে আরও একজনকে করোনায় আক্রান্ত হতে হতো না।

সবকিছুর পরেও ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপর। তিনিই রাহমানুর রাহীম। আল্লাহ চায়তো দেশের মানুষ এই মরণঘাতক থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি।

লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক ও প্রতিদিনের সংবাদের অনলাইন ইনচার্জ

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তমত,রিহাব মাহমুদ,বাঙালি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close