রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১১ মার্চ, ২০২০

শান্তি পরিকল্পনায় অর্থহীন গ্রিনলাইট

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা বিষয়ে ওয়াশিংটনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে দ্য গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের নেতাদের একটি সমঝোতায় আনার চেষ্টা করেছিল। ওয়াশিংটনের গৃহীত আগের যেকোনো শান্তি উদ্যোগের কেন্দ্রেই ছিল দুপক্ষের সমঝোতার বিষয়টি, কিন্তু ট্রাম্পের বক্তব্য বলে দিচ্ছে যে, এবার ওয়াশিংটন ভিন্ন পথ নিতে পারে। তারা হয়তো এমন প্রস্তাব হাজির করবে, যেখানে ফিলিস্তিনের হ্যাঁ অথবা ‘না’ বলে কাজ সারতে হবে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এমন অনুমানের কারণ সম্ভবত ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম। কারণ একই সময়ে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনাটি তাদের জন্য বেশ অনুকূল হবে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বিরাট অঞ্চলজুড়ে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। বিশেষত জেরুজালেমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা পরিকল্পনায় থাকছে বলেও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে ইসরায়েলের স্থানীয় সংবাদপত্রে।

বিপরীতে ফিলিস্তিনিরা ‘কড়া নিয়ন্ত্রণের’ মধ্যে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন পাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা কতটুকু কার্যকর কিংবা সার্থক হবে; সেটাই বিশ্বের কাছে বিতর্কিত। খোদ আমেরিকাতেই প্রস্তাবিত এ শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কথা উঠেছে। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন, এলিজাবেথ ওয়ারেন প্রমুখ এটার সমালোচনা করেছেন। এটা একটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ট এবং এর দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রস্তাবিত পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে এ পরিকল্পনাকে শতাব্দীর সেরা চাপড় বলে অভিহিত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে, ফিলিস্তিনি জনগণের বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, তার নির্দিষ্ট একটা সীমান্ত, আকাশের ওপর অধিকার এবং ভূখন্ডগত জলসীমার অধিকার সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত কোনো শান্তি পরিকল্পনাই কার্যকর ফল নিয়ে আসতে পারে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই কেবল শান্তি আনতে পারে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস—মধ্যপ্রাচ্য-সংক্রান্ত ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে; এত দিন ধরে তারা যেসব অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিল। যেমন পূর্ব জেরুজালেম যেখানে তাদের জাতীয় রাজধানী হবে, ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে ইসরায়েলি বসতি উচ্ছেদ এবং টেরিটরিয়াল সার্বভৌমত্বের ওপর কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ, সীমান্তের এবং আকাশ ও জলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় সবকিছু থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণ বঞ্চিত হবে।

শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করা হবে মর্মে ভাবতে থাকে এবং কয়েক বছর ধরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এটি ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ রাজধানীতে পরিণত হবে; এখানে থাকবে ফিলিস্তিনি আইন সভার মূল কেন্দ্র। আসলে পূর্ব জেরুজালেম (গ্রিনলাইনের পূর্বে শহরটার অর্ধেক অংশ; যার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্ত) রাজধানী হিসেবে গৃহীত হবেএমনটা সবারই ধারণায় ছিল। তাই বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটিকে ইসরায়েলের দখলকৃত ভূমি হিসেবে দেখে এবং তাই সর্বসম্মত ঐকমত্য ছিল যে, এর পরিণতি চূড়ান্ত স্থিতির আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।

কিন্তু ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় গ্রিনলাইনটাকে অর্থহীন করে তুলবে এবং পূর্ব জেরুজালেমের সীমানাকে প্রকৃত শহরের সীমা পেরিয়ে তার আন্তসীমান্তে ফিরিয়ে আনবে। এতে করে পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনির রাজধানী না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন জানুয়ারির ২৮ তারিখে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকএ দুটি অংশে বিভক্ত শান্তি পরিকল্পনার নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বা ‘শতাব্দীর ডিল’ বলে। শতাব্দীর ডিলখ্যাত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই। বিশেষ করে, যাদের উদ্দেশ্যে শান্তি পরিকল্পনা; সেই ফিলিস্তিনিরাই এই শান্তি পরিকল্পনা মূলত প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিষয়টা উপেক্ষিত হয়েছে এবং প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা একপেশে-কেবল ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে এ শান্তি পরিকল্পনায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘে পাস হওয়া ফিলিস্তিন সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলি, ১৯৯৩ সালের অসলো অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যকার সংকট সমাধানের চেষ্টা, ২০০২ সালের আরব শান্তি উদ্যোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে পারে না বলে রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত। অথচ ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় এসব বিষয় গণনার মধ্যেই আনা হয়নি বা এসবের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেকোনো শান্তি পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে, আরো যেসব বিষয়ের সমাধান দেওয়া আবশ্যক তা হলোজেরুজালেমের স্ট্যাটাস কী হবে, কার অধীনে থাকবে, ইসরায়েলি অধিকৃত ভূখন্ডে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের আইনগত অবস্থান এবং নিজ ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা না করে কোনো শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না, শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনায় মূলত এ বিষয়সমূহ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এটা সত্য যে, এসব ভোকাল পয়েন্ট এড়িয়ে গিয়ে কোনো শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেবেন না নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনিরা।

সংক্ষিপ্তভাবে বললে এটাই সত্য যে, স্বাধীন আবাসভূমি ব্যতীত কোনো পরিকল্পনাই তরুণ প্রজন্মের ফিলিস্তিনিরা মেনে নেবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে আল কুদস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুলা হাউল বলেছেন, আবু দিসকে রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়, পূর্ব জেরুজালেমই হবে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী গাজায় হামাস ইসলামপন্থি আন্দোলনে বলেছে যে, জেরুজালেমকে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার বিষয়ে তারা কখনো আপসকে মেনে নিতে পারে না। ‘আমেরিকানরা যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে ফিলিস্তিনি জনগণ এটা ব্যর্থ করে দেবে’বলেছেন ফিলিস্তিনি বাসিন্দা খালেদ সাওফাতা। এদিকে সৌদি আরব সংকট সমাধানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনির মধ্যে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। তবে আরব লিগ সর্বসম্মতিক্রমে শান্তি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। লিগ বলেছে, এ পরিকল্পনা অন্যায্য।

‘আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী এবং আমরা আন্তর্জাতিক বৈধতা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এবং আরব শান্তি উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য একটা আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা আমাদের ইস্যুটার জন্য এর ন্যায়সংগত সমাধানের সন্ধান করছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বৈধতা, কিন্তু আমরা কখনো মেনে নেব না যে, আমেরিকা একমাত্র শান্তি মধ্যস্থতাকারী’বলেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এ শান্তি উদ্যোগ প্রতিরোধ করা হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ উদ্যোগ ব্যর্থ হবে। এদিকে, মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রের এলএসই-এর সিনিয়র ফেলো আয়ান ব্লাক এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, ‘ইসরায়েলের জোটবদ্ধকরণকে সমর্থন করে এবং ফিলিস্তিনিদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বা তাদের অধিকার অস্বীকার করে ট্রাম্প কেবল সংঘাত এবং দ্বন্দ্বকেই জিইয়ে রাখছে।

ইসরায়েলিদের মতো ফিলিস্তিনিদেরও স্বসিদ্ধান্তের অদম্য অধিকার রয়েছেএ মৌলিক বিষয় উপেক্ষা করে স্থায়ী শান্তি স্থাপন কখনো সম্ভব নয়। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো দৃঢ়ভিত্তি দেবে যে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের একমাত্র সমাধান হলো ভূমধ্যসাগর ও জর্ডানের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা; যেখানে আরবরা ইসরায়েলিদের ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে ফিলিস্তিন-আমেরিকান ঐতিহাসিক রশিদ খালিদি তার সদ্য প্রকাশিত এক বইয়ে বলেন, ফিলিস্তিনে এখন দুজন লোক রয়েছে, যতক্ষণ না একে অপরের দ্বারা প্রত্যেকটার জাতীয় অস্তিত্ব অস্বীকার করে; ততক্ষণ তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সমাধান হতে পারে না।

আসলে ট্রাম্পের পরিকল্পনায় নতুনত্ব কিছু নেই। এটা আগের আমেরিকান ও পাশ্চাত্যের প্রস্তাবগুলোর চেয়ে আলাদা কিছু নয়; বরং এটা সাদৃশ্যপূর্ণ। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনাটা গত দেড়শ বছরের ফিলিস্তিন সম্পর্কিত অন্যান্য আমেরিকান ও পশ্চিমা প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত বিষয়ের ন্যায় একই দেউলিয়া নীতির জন্ম দিয়েছে। পৃথকভাবে ও সম্মিলিতভাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারগুলো ইসরায়েলিদের অধিকারের চেয়ে নিকৃষ্ট। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ভিন্ন মত তৈরি হয়েছে। ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে তার প্রস্তাব সাবধানতার সঙ্গে পর্যালোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডোমিনিক রাব এটাকে গুরুতর প্রস্তাব বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অবশ্য ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে চীনও। দুই দেশের সঙ্গে আলোচনা না করে ট্রাম্পের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি। কথিত শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের যেকোনো প্রস্তাবে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ঝাং জুন বলেন, ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা উচিত ছিল। ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গ্রিনলাইট,শান্তি পরিকল্পনা,মধ্যপ্রাচ্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close