রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ নভেম্বর, ২০১৯

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে দ্বিতীয় মহাসমরের প্রাক্কাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তোলে সভ্যতার গুরুতর সংকট। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে উদ্বিগ্ন কবি বলেছিলেন যে, পশ্চিম যখন তাদের সীমারেখার বাইরে বেরিয়ে অন্যকে আঘাত করে, সে আঘাতের যন্ত্রণা তারা টের পায় না। কিন্তু পাল্টা আঘাতটি আছড়ে পড়লেই তটস্থ হয়ে ওঠে, বুকে তাদের কর্কশ শব্দ বাজতে থাকে। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ সেদিন যা বলেছিলেন আজ তা আবার অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে উঠছে। বিজ্ঞান যথারীতি এগোচ্ছে। মানুষ নানা গ্রহ মঙ্গলে প্রবেশ করছে। শরীরী ভাষার অভিব্যক্তিতে, স্লোগানে, বিজ্ঞাপনে হরেক রঙের দিন তো সমাগত। নির্বাচিত রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি গলার স্বর উঁচিয়ে তাদের প্রতিটি অঙ্গীকারকে দীর্ঘ, ঋদ্ধ করে তুলছে।

গত শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝখানে সমরাস্ত্রের যে ঝনঝন আমরা শুনেছি, দেখেছি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতামত্ততার বিশ্বজোড়া কদর্য চেহারা আর স্বৈরতন্ত্রের প্রকট হুঙ্কার, সে রকম পরাক্রান্তের বিস্তার আজ কই? হঠাৎ সভ্যতার ‘কল্পিত’ সংকট আবিষ্কার করে আতঙ্ক বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টা কেন? এ আরেক ধরনের প্ররোচনা নয়তো? তৃতীয়ত, সান্তার মতো পবিত্র লোকপ্রিয় বর্ণময় চরিত্রকে রঞ্জিত সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার মতলব কী? এসব কৈফিয়তলবি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

একসময় পশ্চিম এশিয়ার যে অঞ্চল থেকে সন্ত নিকোলাসের অভ্যুদয় হয়েছিল, আজ সে অঞ্চলে, তার আশপাশে কী ঘটছে? প্রেমের বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে, শিশুদের হাসির বিরুদ্ধে, মানুষের বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে প্রতিদিন, প্রতি মাসে বীভৎস হামলা গর্জে উঠছে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে।

বহির্বিশ্বের দিকে তাকাল দেখা যায়, রাশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ তাদের অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে জিইয়ে রাখছে আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের গৃহযুদ্ধ, ছায়াযুদ্ধ। এসব যুদ্ধে আমাদের উপমহাদেশকেও জড়িয়ে ফেলার সংকেত দিচ্ছে। আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ঘৃণা আর প্ররোচিত অভ্যাসকে প্রশ্রয় দিয়ে মহাভারতীয় সহিষ্ণুতাকে, বহুত্ববাদের মহিমাকে লঘু করে সংকটের পূর্বাভাসকে বাড়িয়ে তুলছে। এই সর্বনাশা সংক্রামক মনোভাবকে সভ্যতার নতুন সংকট না বলে কী বলব? অমৃতাচরণের বিস্তার? এ এক ভয়াবহ সন্ধিক্ষণ। এখানেই সর্বেশ্বরবাদী, সর্বপ্রাণবাদী, লোকেশ্বরবাদী সান্তাক্লজ আমাদের পরম ভরসা। তার সঙ্গে উৎসবে মেতে উঠে, তার সঙ্গে পথ হেঁটে মানুষকে, মানুষের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা একান্ত দরকার। দরকার হিংসা আর প্ররোচনার বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে হাসি আর ভালোবাসার দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলা।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি, আদর্শ, গণতন্ত্রের চর্চা ইত্যাদি নিয়েও নতুন করে কিছু বলার নেই। চরিত্রগত দিক থেকে সবাই প্রায় এক। কোনো দলই গণতন্ত্রচর্চার দিক থেকে পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু সম্প্রতি এ দলের কিছু নেতাকর্মীর কদর্যতা নতুন করে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। অনিয়ম-দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। এই অভিযানে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে। দলীয় পদবি ও দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহারে তারা এত বেশি আবর্জনা ছড়িয়েছেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। যে ক্লাবগুলো ছিল ক্রীড়া-সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র, সেই ক্লাবগুলোতে জুয়ার প্রতিযোগিতার চিত্র ফুটে উঠল। এই ক্যাসিনো অভিযানে এত বিপুল পরিমাণ টাকা একেক জনের আস্তানা থেকে উদ্ধার হলো, তা বিস্ময়কর, যুগপৎ প্রশ্নবোধক বৈকি।

দেশের অপরাধজগৎ সম্পর্কে বিগত কয়েক সপ্তাহে নতুন করে সংবাদমাধ্যমে যেসব চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে এ সত্যই ফের প্রতীয়মান হলো, সবকিছুর মূলেই রয়েছে অপরাজনীতি। অপরাজনীতির অপসংস্কৃতি সমাজ দেহ বিষিয়ে দিয়েছে। তাই শুভ বোধসম্পন্ন রাজনীতিকদের কাছে প্রত্যাশা—রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে এবং দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের প্রয়োজনে তারা নতুনভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে অস্বচ্ছতা-দুর্নীতি-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা নিরসনে নির্মোহ অবস্থান নেবেন। রাজনীতিকরা চাইলে তা নিশ্চয়ই কোনো দুরূহ বিষয় নয়। দরকার শুধু সদিচ্ছা। প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের আত্মসমালোচনায় মগ্ন হলে আশা করি, সুন্দর পথ রচনা কোনোই দুরূহ ব্যাপার নয়। দেশের আর্থিক খাতের অনিয়ম সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী বলবান চক্র সবকিছু খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তারা দেশ-জাতির মিত্র নয়, হতে পারে না রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে যদি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী না হয়ে যদি সত্যিকারভাবে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে অবস্থান নির্ধারণ করেন, তাহলে সুফল না মেলার তো কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই জরুরি কাজটি করার মতো মানসিকতা কতজন পোষণ করেন। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সমালোচনা না করে গঠনমূলক সমালোচনা-আত্মসমালোচনার পথটি মসৃণ করতে দায়িত্বশীলরা মনোযোগ দিন। দেশের সচেতন ও সাধারণ মানুষের মনে তিক্ততার যে পাহাড় গড়ে উঠেছে, তা ভবিষ্যতের জন্য কোনো শুভবার্তা নয়। মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধারে রাজনীতিকরা যেন তাদের দায়টা ভুলে না যান।

এ ছাড়া বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতি দেখে শুধুই হতাশ নন, সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বর্তমান ছাত্ররাজনীতি মানেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্রভাবে দেশ, সব ক্যাম্পাস থেকে একেবারে ওয়ার্ড পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানো। ছাত্ররাজনীতির মূল চেতনাই হলো শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এবং ছাত্র শুধু ছাত্ররাই ছাত্র সংগঠনগুলোর সদস্য হওয়ার কথা। একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাই ক্যাম্পাসের বাইরে ইউনিট রাখার যৌক্তিকতা কোথায়? প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকে তার কর্মীদের জন্য একাডেমিক পড়াশোনায় নিয়মিত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পাঠচক্রের ব্যবস্থা করতে হব, ৩০ বছর বয়স অথবা এইচএসসি পাসের সাল থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন, যেকোনো ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থাই নয়, আইনি ব্যবস্থাও নিতে হবে এবং হলগুলোতে নিয়মিত তল্লাশির মাধ্যমে অস্ত্র, মাদক ও বহিরাগত মুক্ত রাখতে হবে। ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে যোগদান বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে রাজনীতিতে যে অবক্ষয় চলছে যার প্রভাবে সৎ, দেশপ্রেমিক, গণমুখী নেতার যে আকাল দেশে চলছে তার জন্য এই ঘুণে ধরা ছাত্ররাজনীতিও অনেকাংশে দায়ী। যেসব ছাত্রনেতা তার ছাত্রত্বকালে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে ছিল তাদের বৃহৎ একটি অংশ সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।

রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত গুণগত পরিবর্তনের আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—মুক্তিযুদ্ধের ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে, ধর্মীয় নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের নেতারা এবং জাতীয় নেতারা জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবেন, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবেন না, সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হবে, প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়ন ও অবদানের কাঠামো, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সততা ও প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, রাজনীতি ও ব্যবসায় তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এবং বাংলাদেশের সার্বিক কল্যাণ ও নাগরিকদের উপকার কোন কোন পন্থায় করা যায়, এ বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে। দেশে যে অবস্থা বিদ্যমান, তা থেকে পরিত্রাণের পূর্ণশক্তি তথা কাঠামোগত শক্তি দেশের রাজনীতিতে নেই, এমনকি আমলাতন্ত্রেরও নেই। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

দেশে এরূপ পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অতএব এ থেকে পরিত্রাণও এক দিনে পাওয়া যাবে না। পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। মানুষকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে রাজনীতিবিমুখ করা চলবে না। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যে নিয়মে মানুষ রাজনীতিতে প্রবেশ করত এবং যে নিয়মে রাজনীতিতে বিচরণ করত, হুবহু সেই নিয়ম এখানে প্রযোজ্য হবে না। কারণ সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তবে এ পরিবর্তনের জন্য সবকিছুকে বাদ দিলে চলবে না। যেখানে-যেখানে সমস্যা রয়েছে, শুধু সেখানেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনীতি,সংস্কৃতি,কলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close